ড্রপা পাথর – অমীমাংসিত রহস্য ।। Dropa Stone Mystery

মহাবিশ্বের তুলনায় সৌরজগৎ একটি বালিকণাসদৃশ। আর সে বালিকণায় পৃথিবী আমাদের বাসযোগ্য গ্রহ। অজানা এ মহাকাশের আর কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব (এলিয়েন) আছে কিনা, তা নিয়ে গবেষণা চলছে অবিরত।

তাই কোনো কূলকিনারা করতে না পেয়ে আমরা অপ্রত্যাশিত রহস্যময় বস্তু পেলেই তার সঙ্গে এলিয়েনকে জুড়ে দিই। ঠিক এমনই এক অমীমাংসিত রহস্যময় বস্তু হলো ‘ড্রপা পাথর’। সুম উম নেই নামক এক চৈনিক গবেষক এ পাথরকে প্রথম ড্রপা নামক এলিয়েনদের ডায়েরি বলে আখ্যা দেন।

মূলত, ড্রপা পাথর হলো প্রায় ১২ হাজার বছরের পুরাতন ৭১৬টি চাকতি আকৃতির পাথুরে খণ্ড যেগুলোর ওপর সাংকেতিক ভাষায় বিভিন্ন তথ্য উৎকীর্ণ আছে। এই পাথরের চাকতিগুলোর প্রতিটির ব্যাস ১ ফুট এবং এদের মধ্যে একটি গর্ত রয়েছে, যা দিয়ে সর্পাকারে দুটি ছাঁচ আটকে রাখা হতো। হায়ারোগ্লিফের মতো সাংকেতিক চিহ্নগুলো এই ছাঁচে খোদাই করা ছিল।

ড্রপা এবং ড্রপা পাথর সম্পর্কিত সর্বপ্রথম একটি তথ্যসূত্র ১৯৬২ সালের ‘দ্য ওয়েগেটারাইশি ইউনিভার্সাম’ নামক একটি জার্মান উদ্ভিদ সম্পর্কিত সাময়িকীতে পাওয়া যায়।

Image: Dropa Stone Mystery

১৯৩৮ সালে বেজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক চি পু তেই প্রায়ই তার ছাত্রদের নিয়ে তিব্বত সীমান্তে অভিযানে যান। সেখানে ‘বায়ান কারা উলা’ পর্বতের বেশকিছু গুহা পর্যবেক্ষণের সময় এক অদ্ভুত গুহার সন্ধান লাভ করেন।

গুহার দেয়াল বেশ মসৃণ ছিল। গুহার ভেতরটা বেশ উষ্ণ ছিল। অনুসন্ধানের একপর্যায়ে তারা বেশকিছু সারিবদ্ধ সমাধির সন্ধান লাভ করে। প্রায় ৪ ফুট ৪ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের কবরগুলো খনন করতেই বেরিয়ে আসে কঙ্কাল।

কিন্তু এসব কঙ্কালের মাথার খুলিসহ বিভিন্ন হাড় স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় আকারে বেশ বড় ছিল। অধ্যাপক চি পু তে এসব কঙ্কাল মানুষের নয় বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন।

একপর্যায়ে আরও অনুসন্ধানে তারা এক ফুট ব্যাসার্ধের শত শত পাথুরে চাকতির সন্ধান লাভ করে। পাথরের গায়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিষয়বস্তু, যেমন – সূর্য, চন্দ্র, পাখি, ফল, বৃক্ষ প্রভৃতি বেশ যত্ন করে খোদাই করা ছিল। অধ্যাপক চি পু তেই প্রায় কয়েকশ চাকতি নিয়ে বেজিংয়ে ফেরত যান।

Image: Dropa Stones

ধীরে ধীরে চীন ছাড়িয়ে পুরো পৃথিবীতে এই পাথুরে চাকতির গল্প ছড়িয়ে পড়ে। গবেষকগণ এই পাথুরে চাকতির নাম দেন ‘ড্রপা পাথর’। ড্রপা পাথরের গায়ের সাংকেতিক ভাষার মাঝে কোন অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে, তা ভেদ করতে উঠে পড়ে লাগেন বিজ্ঞানীরা।

ড্রপা পাথরের ‘ড্রপা’ নামের আবিষ্কারক বেজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের রহস্যময় গবেষক সুম উম নেই। প্রায় চার বছরের গবেষণা শেষে দুর্ভেদ্য ড্রপার রহস্যের তিনি এমন সমাধান দেন, যা শুনে ইতিহাসবিদ এবং পুরাতত্ত্ববিদরা তা হেসে ছুড়ে ফেলেন।

সুম এক জার্নালের মাধ্যমে দাবি করেন, পাথরের গায়ে হায়ারোগ্লিফিক বর্ণ দ্বারা ‘ড্রপা’ নামক এক ভিনগ্রহের জাতির সফরনামা লিখিত রয়েছে। তিনি একটি চাকতি সম্পূর্ণ অনুবাদ করেন এভাবে ‘আমরা মেঘের ওপর থেকে মহাকাশযানে চড়ে মাটিতে অবতরণ করি। আমরা আমাদের সন্তানেরা এই গুহায় প্রায় ১০ সূর্যোদয় পর্যন্ত লুকিয়ে থাকি। কয়েক দিন পর যখন আমরা স্থানীয়দের দেখা পাই, তখন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। ইশারায় যোগাযোগ করতে সক্ষম হওয়ায় আমরা গুহা থেকে বেরিয়ে আসি।’

সুম এর মৃত্যুর পর ১৯৬৮ সালে ড্রপা পাথর রুশ বিজ্ঞানী ভায়াস্লভ সাইজেভের গবেষণাগারে স্থানান্তরিত হয়। তখন সামনে চলে আসে আরও রহস্য আর কিছু প্রশ্ন! তিনি চাকতির বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেশকিছু পরীক্ষা চালান। তার মতে ড্রপা পাথরের পাথরগুলো মূলত একধরনের গ্রানাইট পাথর যার মাঝে কোবাল্টের পরিমাণ অনেক বেশি।

Image: Dropa Stone Mystery

প্রশ্ন উঠে, তৎকালীন অধিবাসীরা ঠিক কীভাবে এই শক্ত পাথরের মাঝে সাংকেতিক চিহ্ন খোদাই করেছেন? সাইজেভের মতে, ১২ হাজার বছর পূর্বে এমন কোনো পদ্ধতি ছিল না, যা দিয়ে এরূপ পাথরের মাঝে খোদাই করা সম্ভব!

রুশ বিজ্ঞানীরা অসিলোগ্রাফের মাধ্যমে এই পাথর পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন যে, কোনো একসময়ে এই পাথরগুলোতে বৈদ্যুতিক বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু কখন বা কীভাবে? এ আরেক প্রশ্ন!

এরপর ১৯৭৪ সালের কথা। অস্ট্রিয় প্রকৌশলী আর্নেস্ট ওয়েগারার সেবার চীনের বানপো জাদুঘর পরিদর্শনে ড্রপা পাথরের দুটো চাকতি দেখতে পান। তিনি কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে চাকতি দুটোকে ক্যামেরাবন্দি করেন।

কিন্তু এই ঘটনার কিছুদিন পরেই তৎকালীন জাদুঘরের মহাব্যবস্থাপককে বিনা কারণে বরখাস্ত করা হয় এবং চাকতি দুটো ধ্বংস করে ফেলা হয়। এই রহস্যময় ঘটনার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ড্রপা পাথর নিয়ে বহু গবেষণা হলেও নানা বিতর্কের কারণে গবেষণার অগ্রগতি একদম শূন্যই বলা যায়। আর যেহেতু পাথরগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে তাই ড্রপা পাথর পৃথিবীর একটি অমীমাংসিত রহস্যই রয়ে গেল।

লেখকঃ অরিজিৎ সিংহ মহাপাত্র (সহযোগী সম্পাদক, মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া)।
তথ্যসূত্রঃ- যুগান্তর পত্রিকা।

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত