জল সংকটে শিল্পের অবদান

‘জল’ সমগ্র জীবজগতের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান I জীবদেহের প্রায় 70 শতাংশ জল দ্বারা গঠিত I জলের অস্তিত্বই জীবনের অস্তিত্ব I একজন মানুষ খাবার ছাড়া প্রায় তিন সপ্তাহ বেঁচে থাকলেও জল ছাড়া বাঁচতে পারে মাত্র কয়েক দিন I বিজ্ঞান অনুযায়ী জল থেকেই জীবনের উৎপত্তি, আবার হিন্দু পুরান অনুযায়ী বিষ্ণুর দশ অবতারের প্রথম অবতার ‘মৎস্য’ – যার আবির্ভাব জল থেকেই I অর্থাৎ ধর্মীয় ধারণা থেকে বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরের বিচারে জীবজগতের সৃষ্টিতত্ত্বের মূলে রয়েছে জল, যাকে জীবনের আধার বলাহয় I তাই জলের অপর নাম জীবন I

আমরা সকলেই জ্ঞাত যে, জল ছাড়া জীব কয়েক মুহুর্ত টিকে থাকবে না, তবুও আমরা তার সংরক্ষণের পরিবর্তে যথেচ্ছ ব্যবহারেই অধিক অভ্যস্ত I সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ‘বিশ্ব জল দিবস’ (22 সে মার্চ) পালিত হলেও তার আড়ম্বরের সাথে সাযুজ্য রেখে সচেতনতার প্রভাব কতখানি পড়ে সমাজ জীবনে তার কোন সঠিক তথ্য আমাদের জানা নেই I আমরা এতোটাই পরোপকারী যে নিজের প্রয়োজনীয় জল সংগ্রহের পর নিঃসঙ্কোচে অন্যের জন্য জলের নল খুলে রেখে দিই I তথ্য বলছে প্রতিবছর জল সরবরাহের নল থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে যে জল পড়ে অপচয় হয় তার পরিমাণ 12000 লিটার I কিন্তু এর থেকেও ভয়াবহ ও ভয়ঙ্কর রূপের কথা হয়তো আমরা চিন্তাই করিনা I

Water pollution

এমন কিছু শিল্প রয়েছে যেখানে স্বচ্ছ জল ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হয় কোন বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করেই I আবার এই ঘটনাকে আড়াল করার জন্য ঐ শিল্পের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পানীয় জলের ব্যবস্থা করে দেয় সংশ্লিষ্ট শিল্প সংগঠন I কারণ কি জানেন ? কারন হল শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় স্বচ্ছ জল পেতে শিল্প সংস্থা ভূগর্ভে গভীর থেকে জল তুলে নেওয়ায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে জলস্তর নীচে নেমে যায় I ফলে পানীয় জলের টিউব ওয়েল বসিয়ে আর জল মেলেনা I এর ফলে জন বিশৃঙ্খলা হতে পারে তাই আগে থেকেই পানীয় জলের ব্যবস্থা করে জনগণের উপকারে নেমে পড়ে I

Water pollution

যাইহোক মুনাফা যেখানে মূল লক্ষ্য সেখানে নীতিজ্ঞান প্রতিবন্ধী I তাই সমাজের অগ্রগতির সাথেসাথেই এক বাহু যেমন ফাইলেরিয়ার সংক্রমণে আক্রান্ত তেমনি অন্য বাহু রিকেটে I বলতে গেলে মুনাফা সর্বস্ব অর্থনীতিতে ধনী আরো ধনী এবং গরীব আরো গরীবে পরিণত হচ্ছে, কিন্তু চাহিদার পরম্পরায় জলের চাহিদা অপরিবর্তিত I ইতিমধ্যেই ‘জল দুর্ভিক্ষে’ পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মেরুদণ্ডে শীতল হিমস্রোত বইয়ে দিলেও নিরন্তর জলের অপব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে I গত 50 বছরে স্বচ্ছ জলের উত্তোলন বেড়েছে তিন গুণ এবং বছরে 64 বিলিয়ন ঘন মিটার হারে জলের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে I

দেশ ভিত্তিক স্বচ্ছ জল উত্তোলনে ভারতের স্থান প্রথম I আমাদের দেশে বছরে প্রায় 654.84 ঘন কিঃমিঃ হারে জল উত্তোলিত হয়, যার মাথাপিছু পরিমাণ 585 ঘন মিটার I এর পর চীনের স্থান I চীন বছরে 549.76 ঘন কিঃমিঃ জল উত্তোলন করে থাকে I আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এই পরিমাণ 477 ঘন কিঃমিঃ এবং রাশিয়ার 76.68 ঘন কিঃমিঃ I এই জলের 70% ব্যবহার হয় কৃষি কার্যে, 20% শিল্প ক্ষেত্রে এবং মাত্র 10% ব্যবহার হয় গৃহস্থলির বিভিন্ন কার্যে I অর্থাত্ জলের একটা মোটা অংশ খরচ হয়ে যায় কৃষি কার্যে I তবুও বলা যায় জল অপচয়ে শিল্পের ভূমিকাই প্রধান I কারণ কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত জলের অধিকাংশই পুনরায় স্বচ্ছ ভাবেই (কম বেশী উর্বরক মিশ্রিত হলেও তা একে বারেই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে না) পুনঃ মাটিতে প্রবেশ করে ভূঅভ্যন্তরে জলস্তরে সঞ্চিত হয় I কিন্তু শিল্পে ব্যবহৃত জল পুনঃ ব্যবহারের অনুপযোগী তো বটেই এমনকি অধিকাংশ শিল্প থেকে বর্জিত জল স্বচ্ছ জলের সাথে মেশে তাকেও দূষিত করে তোলে I যেখানে 1 মেট্রিকটন শষ্য উত্পাদনে গড়ে 1 মিলিয়ন লিটার জলের প্রয়োজন হয় সেখানে 1 কেজি তামা তৈরিতে জলের প্রয়োজন হয় 440 লিটার I তাই কৃষিকাজে জলের ব্যবহার অধিক হলেও অপচয় তুলনামূলকভাবে শিল্পক্ষেত্র থেকে অনেক কম I

Water crisis

বিশ্বে Metal এবং Paper Industry তে জলের ব্যবহার অন্যান্য শিল্পের তুলনায় অনেকগুণ বেশী I তামার পর অধিক জলের প্রয়োজন হয় অ্যালুমিনিয়াম তৈরিতে I 1 কেজি অ্যালুমিনিয়াম তৈরিতে জল লাগে 410 লিটার, অনুরূপভাবে 1 কেজি স্টিল ও কাগজ তৈরিতে জলের প্রয়োজন হয় যথাক্রমে 260 লিটার ও 125 লিটার I ইউরোপের দেশগুলিতে 40% জল ব্যবহার করা হয় শিল্পে I

শিল্পে জলের ব্যবহার মূলতঃ ধৌতিকরণ,শীতলীকরণ এবং পরিশুদ্ধিকরণের কাজে ব্যবহৃত হয় I ঐ জল আবার পরিবেশে চরম দূষিত অবস্থায় ফিরে আসে এবং পতিতস্থলের জীববৈচিত্র সমেত ভূগর্ভস্থ জল ও ভূপৃষ্ঠস্থ জল কে দূষিত করে তোলে যা স্বচ্ছ জলের যোগানে অন্তরায় I এ যেনো গোদের উপর বিষফোঁড়া I WDR 2003 অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশ 70% শিল্প-বর্জ্যজল বিনা শোধনেই পরিবেশে মুক্ত করে I ফলে উন্নয়নশীল দেশ সমূহে 80% রোগের আঁতুড় ঘর দূষিত জল I যা থেকে বছরে প্রায় 3 মিলিয়ন লোকের মৃত্যু হয় I প্রতিদিন 5 হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটে ডায়েরিয়াতে I UNESCO & WWAP (2006) এর একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বছরে 221 ঘন কিঃমিঃ, চীন বছরে 162 ঘন কিঃমিঃ জল শিল্প ক্ষেত্রে ব্যবহার করে I যেখানে ভারত, জার্মানী ও জাপান বছরে যথাক্রমে 35, 32 ও 16 ঘন কিঃমিঃ জল শিল্প ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকে I
মুষ্টিমেয় ধনকুবেরের হাতে রয়েছে বৃহদায়তন শিল্পের সিংহভাগ যার লভ্যাংশ ভোগ করে তারা I

Water crisis Sudan

অন্যদিকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের দোহাই দিয়ে প্রকৃতির বুক থেকে পানীয় বা স্বচ্ছ জল তুলে নিয়ে প্রকৃতিকে রিক্ত করে তুলছে দিনদিন I তাড়াতাড়ি যদি শিল্প ক্ষেত্রে জলের অবাধ ব্যবহার বন্ধ না করা হয় অথবা বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণ না করা হয় তাহলে শিল্প উপযোগিতা ও মুনাফা ভোগ করার জন্য আর মানুষের অস্তিত্বই থাকে কি না সন্দেহ I আবার পরিবেশ বিজ্ঞানীদের একাংশের এও ধারণা যে ভাবী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়তো বা জলের জন্যই ঘটতে পারে I ইতিমধ্যেই আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ জলের অভাবে গৃহযুদ্ধের দোরে দাঁড়িয়ে রয়েছে I এর পরও যদি শিল্প বিকাশের নামে যথেচ্ছ ভাবে জল ব্যবহার হয় তাহলে সমগ্র পৃথিবীর জীব কুলের বিনাশ নিশ্চিত I

-গোপাল মণ্ডল।।
সহকারী সম্পাদক, মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া।

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত