বৃষ্টি রহস্য ।। Mystery of Rain: The Untold Story

মিস্ট্রি অফ রেইনঃ দ্য আনটোল্ড স্টোরি

মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া: আমরা এমন একটি গ্রহের খোঁজ করেছি যেখানে বিভিন্ন ধরনের জলবায়ু, অচেনা দৃশ্য এবং যেখানে প্রতি মুহূর্তে কিছু না কিছু অদ্ভূত ঘটনা ঘটে চলেছে। এই গ্রহ ব্রহ্মাণ্ডের সবথেকে অদ্ভূত গ্রহ — আর এই গ্রহ হল আমাদের বাসভূমি পৃথিবী। আমরা এর রহস্যকে এইমাত্র জানা শুরুই করেছি।

আমাদের পৃথিবীতে এমন একটি প্রক্রিয়া রয়েছে যেটা আমাদের কাছে একটি সাধারণ ব্যাপার। এটি ব্রহ্মাণ্ডের শুধুমাত্র অদ্ভূত ঘটনা নয়, এটি ছাড়া মানুষের অস্তিত্বও থাকত না। আমাদের শরীরে এক এক বিন্দু জল কোটি কোটি বছর ধরে রয়েছে। এমনও হতে পারে আমাদের শরীরে সেই জলই রয়েছে, যে জল আইস্টাইন কিংবা জর্জ ওয়াশিংটন এর শরীরে ছিল। এই প্রক্রিয়া হল বৃষ্টিপাত। প্রকৃতির জানা কিন্তু খুব শক্তিশালী শক্তি একে ঘটায়। এর মধ্যে রয়েছে অনেক রহস্য এমনকি জীবনও।

চিত্র: মহাকাশ থেকে পৃথিবী

আকাশ থেকে আমাদের পৃথিবীকে অরূপ সুন্দর দেখায়। সৌরমণ্ডলের মধ্যে আমাদের পৃথিবী সবথেকে অদ্ভূত — কারণ এর উপর বিশাল সমুদ্র আছে। আর এর আকাশ থেকে জল ঝরে পড়ে। যখন আপনি মহাকাশ থেকে পৃথিবীর ছবি দেখেন তখন দুটি জিনিস অবশ্যই লক্ষ্য করেন এক সাদা মেঘ, আর অপরটি নীল সমুদ্র। সমুদ্র, বয়ে যাওয়া নদী, ঝর্ণা, গাছের পাতা ও ঘরের গায়ে লেগে থাকা জল আমাদের Water Cycle বা জলচক্রের অংশ। সেই Cycle যার জন্য পৃথিবীতে জীবন রয়েছে। এমনকি আমরাও এই জলচক্রের একটি অংশ।

চিত্র: Death Valley

পৃথিবীর অন্যতম শুষ্ক মরুভূমি, যা Death Valley নামে পরিচিত, তাকেও বৃষ্টির জল বর্তমান আকার দিয়েছে। এখানে একসময় নদী বয়ে গিয়েছিল, যার জন্যই এখানকার পাহাড়ে সুন্দর সুন্দর আকৃতির ভূমিরূপ সৃষ্টি হয়েছে।

বৃষ্টি দেখতে সহজ মনে হলেও খুব কম লোকই জানে বৃষ্টি কেমন করে হয়। যেমন মহাকাশ থেকে আসা ক্ষুদ্র কণা এবং ভূপৃষ্ঠের সূক্ষ্ম জীব আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরতে সাহায্য করে। বৃষ্টির রহস্যের শুরু হয় এক বিশেষ রূপে, যা তরল নয়। ভূপৃষ্ঠের অনেক উপরে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির থেকে অনেক কম হয়। অনেক স্কুলে পড়ানো হয় শূন্য ডিগ্রিতে জল বরফ হয়ে যায়। কিন্তু আকাশে এই রকম হয় না। উষ্ণতা শূন্যের থেকে কম হলেও জল বরফে পরিণত হতে পারে না , কারণ এর জন্য দরকার মৃত্তিকার সূক্ষ্ম কণার। যা অতি শীতল তরল জলকে বরফের কেলাসে পরিণত করে।

অনেক ছোট কণা, যেমন – বালি, লবণকণা, ছাইয়ের কণা বাতাসের দ্বারা আকাশে মেঘের মধ্যে চলে যায়। আবার কিছু কণা মহাকাশ থেকেও আসে। প্রতিদিন ২৭৩১ কিলোগ্রাম। এই কণা এতটাই ক্ষুদ্র যে পৃথিবীতে আসার সময় ঘর্ষণে পুড়ে যায় না। অনুমান করা হয়, এই মাইক্রোমিট্রোরাইটের জন্য পৃথিবী প্রতিবছর ১০০০০ টন করে ভারী হচ্ছে। এই মাইক্রোমিট্রোরাইট যখন মেঘের অতিশীতল জলকণার মধ্যে প্রবেশ করে, তখন সেই জলকণা Crystral হয়ে জমে বরফে পরিণত হয়।
আর সেই বরফ কণাকে কেন্দ্র করে আশেপাশের জলকণা একত্রিত হয়ে বড়ো বরফ কণায় পরিণত হয়। আর সেই বরফ কণা ভারী হয়ে নীচে নামতে শুরু করলে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে গলতে শুরু করে এবং জলকণা রূপে ভূপৃষ্ঠে ঝরে পড়ে।

চিত্র: সিউডোমোরাস সিরিঙ্গে

অদ্ভূত ব্যাপার এই যে জীবন্ত প্রাণী থেকেও Ice Crystral -এর সৃষ্টি হতে পারে। অতি ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া, যেমন সিউডোমোরাস সিরিঙ্গে বাতাসের দ্বারা আকাশে উঠে ভেসে বেড়ানো অতি শীতল জলকণার মধ্যে প্রবেশ করে অতি দ্রুত বরফ কণায় পরিণত করতে পারে। সেই বরফ কণা মধ্যাকর্ষণে নীচে নামার সময় সূর্যরশ্মির তাপে গলে গিয়ে বৃষ্টিরূপে ঝরে পড়ার সময় সেই সিউডোমোরাস সিরিঙ্গে আবার ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে।

কিন্তু সিরিঙ্গের এই রহস্য ততটা অদ্ভূত নয় যতটা পৃথিবীতে পড়া বৃষ্টি আর আমাদের শরীরে থাকা জলের রহস্য। প্রত্যেক মানুষের শরীরে যেমন আপনার শরীরে সেই জলই রয়েছে যে জল ডাইনোসর আর পৃথিবীতে চলা মানুষের শরীরে ছিল। কেননা মানুষের শরীরে সবথেকে বেশি জল থাকে, তার জন্য মানুষও এই বর্ষাচক্র বা জলচক্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মানুষের শরীর ৬০% জল দিয়ে তৈরি, মস্তিষ্ক ৭০% জল দিয়ে তৈরি। আর ফুসফুসে ৯০% জল থাকে। আর এই জলই সবসময় Recycle হয়ে যাচ্ছে যখন থেকে পৃথিবীতে প্রথমবার বৃষ্টি হয়। তারপর ডাইনোসর এর যুগ আসে, তারপর মানবজাতির বিকাশ ঘটে। এই সময়কালে জল যা ছিল তাই -ই বর্তমানে রয়েছে।

যে সমস্ত জল আমাদের দেহে এখন রয়েছে তা কোটি কোটি বছর ধরে এই পৃথিবীতেই রয়েছে। এমনও হতে পারে কারও শরীরে সেই জলই রয়েছে যে জল আইস্টাইন কিংবা জর্জ ওয়াশিংটন এর শরীরে ছিল।
পৃথিবীতে জল বৃষ্টি রূপে ঝরার জন্য সর্বপ্রথম জলকে কঠিন কণার সাথে জমতে হয়। যেমন — মাইক্রোমিটোরাইট অথবা সূক্ষ্ম জীব। কিন্তু এই জল আকাশে পৌঁছায় কীভাবে?

সূর্যকিরণ আমাদের পৃথিবীকে গরম করে। ঘর-বাড়ি, রাস্তা, গাছপালা, নদী-সমুদ্র থেকে জল ধীরে ধীরে গরম হতে থাকে আর বাষ্প রূপে উপরে উঠতে থাকে। ভূপৃষ্ঠের জলের কণা সূর্যের গরমে শুকোতে শুরু করে। এই শক্তির জন্য জলের কণা একে অপরের থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। আর তরল জল বাষ্পে পরিণত হয় এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেই বাষ্প উপরে উঠতে থাকে। যখন জলকণা গরম হয় তখন তা অস্থির হয়ে হালকা হতে থাকে। আর তখন তা গ্যাস বেলুনের মতো উপরে উঠতে থাকে এবং সঙ্গে জলীয় পদার্থ নিয়ে যায়। পুরো পৃথিবী থেকে ৭২৬ টন পেট্রোলিয়াম জল প্রত্যেক বছর সমুদ্র ও নদী থেকে বাষ্প রূপে উপরে উঠতে থাকে। বাষ্পের এই কণা প্রায় ১০ দিন ধরে বাতাবয়নে ভাসতে থাকে। এই ১০ দিনে জলের কণা ১০০০ কিমিরও বেশি যাত্রা করে। প্রত্যেক সময় আকাশে লক্ষ কোটি লিটার জল থাকে। যদি এই জল একসাথে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয় তাহলে সমুদ্র ও স্থলভাগকে এক ইঞ্চি জলে ঢেকে দিতে পারে।

যখন জল বাষ্প রূপে উপরে উঠতে থাকে তখন ঠান্ডাও হতে থাকে। আর প্রত্যেক হাজার মিটারে ৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম হতে থাকে। ঠান্ডা হওয়ার সাথে সাথে বাষ্প ঘন হতে থাকে। তখন একটা সময় আসে যখন জলের কণা একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে পুনরায় আবার তরলে পরিণত হয়। যদি আরও জলকণা যুক্ত হতে থাকে তাহলে সেটা ভূপৃষ্ঠ থেকে দেখতে পাই। যাকে আমরা বাদল বলি। অর্থাৎ আমরা জলের কণাকে যুক্ত হতে দেখতে পাই যা সূর্যের রশ্মিকে প্রতিফলিত করে আর সাদা মেঘ রূপে আমাদের নজরে আসে।

সৌরমণ্ডলে মেঘ তৈরি বিশাল ঘটনা নয়। শুক্র গ্রহে সালফিউরিক অ্যাসিডের মেঘ তৈরি করে যা সূর্যের রশ্মিকে মহাকাশে প্রতিফলিত করে। এর জন্য সেই গ্রহকে চমকানো লাগে। আর এর জন্যই হয়তো শুক্রগ্রহ অর্থাৎ ভেনাসের নাম সুন্দর দেবতার নাম অনুসারে হয়েছে। এছাড়াও মঙ্গল গ্রহে হালকা কার্বন ডাই অক্সাইডের মেঘ সৃষ্টি হয়।

আমাদের পৃথিবীতে মেঘে জলের কণা খুব ছোট ও হালকা হয়। যার জন্য ভূপৃষ্ঠে পড়তে পারে না। এই জলকণা পড়ার জন্য লক্ষ লক্ষ জলের কণা যুক্ত হতে হয়, বরফের কেলাস তৈরি হতে হয়। আর এই বরফের কেলাস তৈরি হওয়ার জন্য জলকণাকে কঠিন পদার্থের প্রয়োজন হয়। আর এই কেলাসের জন্য আধান বানায় পৃথিবীতে থাকা ধুলিকণা, জঙ্গলের আগুনের কণা, আগ্নেয়গিরির ভস্মীভূত কণা, মহাকাশের মাইক্রোমিট্রোরাইট আর পৃথিবীর অতি সূক্ষ্ম জীব। কিন্তু অনেক সময় পৃথিবীতে আকাশ থেকে অদ্ভূত পড়ে বৃষ্টির সাথে।

পৃথিবীতে জলকণার এই বৃষ্টি সৌরমণ্ডলের সবচেয়ে সুন্দর ঘটনা। কিন্তু আমাদের ব্রহ্মাণ্ডে অনেক ধরনের বৃষ্টিও হয়। শুক্রগ্রহে সালফিউরিক অ্যাসিডের বৃষ্টি হয়। আবার টাইটনে মিথেনের মতো মেঘের সৃষ্টি হয়। আবার আমাদের পৃথিবীতেও অনেক অদ্ভূত বৃষ্টিও হয়।

চিত্র: মাছ বৃষ্টি (থাইল্যান্ড) 

ইতিহাসে অনেক লোক আকাশ থেকে ব্যাঙ ও মাছ পড়ার কথা বলেছেন। আপনি বিশ্বাস করুন বা না করুন এই ব্যাঙ ও মাছ পড়ার কাহিনী সত্যি। বিংশ শতাব্দীতে এই কাহিনীর উপর ৬০০ এর বেশি খবর লেখা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ১৯০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার ঘটনা আর ১৯৫২ সালে ফ্লোরিডার ঘটনায় বলা হয়েছে আকাশ থেকে মাছ পড়ার কথা। ১৯৬৯ সালে ইংল্যান্ডের বাকিংহাম শহরে আকাশ থেকে ব্যাঙ পড়ে। এই রহস্যময় বৃষ্টির পেছনে প্রকৃতির সাধারণ প্রক্রিয়া আছে। যাকে ওয়াটার প্ল্যাউন্ড বলে। টর্নেডো ঘন্টায় ৩৩১ কিমি গতিবেগে ঘুরতে থাকে। এই টর্নেডোর কুণ্ডলীর মধ্যে সমুদ্রের মাছ ঘুরতে থাকে। ঝড়ের বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও হাওয়া এতো তেজ হয় যে, সমুদ্রের মাছ ঘন্টায় ১৬০ কিমি গতিবেগে ছড়িয়ে যায়। এরপর শেষ পর্যন্ত ঝড় শান্ত হয়। আর পৃথিবীতে অদ্ভূত ধরনের বৃষ্টি হয়। আর সেই মাছ বৃষ্টির সাথে মাটিতে পড়ে।

চিত্র: টর্নেডো

কিন্তু জলের এই সৃষ্টি শত শত বছর ধরে পৃথিবী গোপন রেখেছিল। এখন আমরা মানুষ বুঝতে পেরেছি আকাশ থেকে পড়া বৃষ্টি কীভাবে কঠিন-তরল-বাষ্প হয়। এটা এমন একটি ঘটনা যা সৌরমণ্ডলে কেবলমাত্র পৃথিবীতেই হয়। আমরা এটাও জানলাম কীভাবে বৃষ্টি তাপ ও চাপের জন্য নয় জ্বালামুখী, ধুলিকণা, মহাকাশীয় কণা ও অতি সূক্ষ্ম জীব থেকে সৃষ্টি হয়। আর সবথেকে জরুরি কীভাবে বৃষ্টি এই পৃথিবীকে সৌরজগতের সাধারণ গ্রহ থেকে অদ্ভূত গ্রহে পরিণত করে তাও আমরা জানলাম।

তথ্যসূত্রঃ- Discovery Science, National Geographic, Wikipedia
লেখকঃ- সৌরভ সরকার (সম্পাদক, মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া)
প্রথম প্রকাশঃ “ভূগোলিকা” ফেসবুক পেজ, প্রথম বর্ষপূর্তি – ৩০/০৩/২০১৮

‘মিস্ট্রি অফ রেইনঃ দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ প্রবন্ধটি মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া ম্যাগাজিনের তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে (৩০শে জুন, ২০১৮)।

©Mission Geography India. 

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত