জৈবদস্যুতা (Biopiracy)

‘Bio’ অর্থাৎ জৈব বা জীবজ, ‘Piracy’ শব্দটি এসেছে ‘Pirates’ বা বাংলায় যাকে আমরা বলি ‘দস্যু’। Biopiracy বা জৈবদস্যুতা বর্তমানে এক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সাধারণত পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে অধিক উন্নয়নের জন্য জমির ওপর মানুষের ও নিত্যনতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার দরুণ জৈব সম্পদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার কমে এসেছে, সেই সাথে জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় সেই সম্পদ পুনরায় বৃদ্ধির সম্ভাবনাটাও ক্ষীণ হতে থাকে তবে সেইসব দেশেই জৈবসম্পদের চাহিদা ক্রমেই বেড়ে উঠেছে। এই অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে যখন কোনো দেশ অন্যান্য দেশের জৈব সম্পদের ওপর অধিকার আরোপ করে প্রায় বেআইনিভাবেই, সেটি জৈবদস্যুতা নামে পরিচিত।

সাধারণত উন্নত দেশের তুলনায় অনুন্নত দেশগুলিতেই অর্থাভাব ও সঠিক উন্নয়নের পথ না থাকায় তাদের দেশীয় সম্পদের ওপর অধিক নির্ভর করতে হয়, সে চিকিৎসা ক্ষেত্রে হোক বা শিল্পউন্নয়নের জন্য। তাই দেশীয় মানুষদের মধ্যেই মূলত বিভিন্ন গাছপালা নিয়েই প্রাচীনপন্থী কিছু ধারণা দেখা যায় যা পরবর্তী কালে চিকিৎসা ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। তবে এই ধারণা ভবিষ্যতে আরও ছড়িয়ে পড়বার সম্ভাবনা থেকে যায়, এর জিনগত বৈচিত্রতা ও কিছু বায়োলজিক্যাল বৈশিষ্ট্যগুলির ওপর, যাকে সঠিক ভাবে কাজে লাগালে এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্ম উপকৃত হতে পারে। কিন্তু দেশীয় মানুষদের এই অর্জিত জ্ঞান তাদের নামে স্বীকৃতি পাবার আগেই কিছু বৈদেশিক শক্তি সেগুলো তাদের পেটেন্ট করে নেয়, যা জৈবদস্যুতার এক ভয়ানক রূপ, স্বভাবতই দেশীয় অর্থনীতি একভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হয়ে পড়ছে। এই piracy বিভিন্ন ক্ষেত্রে হতে পারে, যেমন — কৃষি, ঔষধি উদ্ভিদ, খাদ্যশস্য প্রভৃতি।

বৈদেশিক শক্তিগুলো অনেকাংশেই লাভবান হতে পারে এই Biopiracy এর মাধ্যমে। Nanotechnology এবং Synthetic Biology সম্বন্ধীত যে পেটেন্ট (Patent) রয়েছে তার দ্বারা এখন বিশেষভাবে লাভবান হচ্ছে উন্নত দেশগুলি, সাথেই বর্তমানে Cellular Functioning এর মাধ্যমে পরিবেশীয় উপাদানগুলোর বাণিজ্যিক মূল্য অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে।

জানা যায় ৩৫০০ বছর আগে মিশরীয়রা উদ্ভিদ গার্হস্থ্যকরণ করেছিলেন, পরবর্তীতে একে একে ব্রিটিশ শাসনকালেও এই চিত্র দেখা যায়, এমনকি চার্লস ডারউইনও উদ্ভিদ সংরক্ষণ এর পক্ষেই ছিলেন। এভাবেই ব্রাজিলের রবার গাছ দঃ-পূঃ এশিয়াতে চাষ করা হয় এবং সিঙ্কোনা গাছের বীজ বলিভিয়া থেকে ভারতে আনা হয়।

মূল কারন হিসেবে চিহ্নিত করতে গিয়ে গবেষকরা বলেন, মূলত একচেটিয়া প্রতিযোগিতাতে টিকে থাকতে বড় বড় বৈদেশিক শক্তিগুলো নিজেরা সময় নষ্ট করে জৈবসম্পদ গুলোর নমুনা একক ভাবে সংগ্রহ করে না, তাই সবসময় তাদের লক্ষ্য থাকে কিভাবে অন্যের আবিষ্কৃত পরিবেশীয় উপাদানগুলোকে নিজেদের পেটেন্ট (Patent) বানিয়ে তা থেকে আরও লভ্যাংশ অর্জন করা। তবে বৈদেশিক শক্তিগুলোকে এর বদলে অনেকটা অর্থ ব্যয় করতে হয়, যেমন — কোন দেশ দ্বারা আবিষ্কৃত জৈবসম্পদকে আরও বেশি পরিমাণে অর্থ লাগিয়ে সেই এলাকাকে অবৈধভাবে নমুনা সংগ্রহের কাজে লাগানো হয় এবং দ্বিতীয় বৃহৎ কোন দেশকে সেই নমুনা সংগ্রহ করার ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন স্কলারশিপ (Scholerships), প্রজেক্ট ফান্ডিং (Project Funding), টেকনোলোজিক্যাল হার্ডওয়ার (Technological Hardware) দিয়ে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলকে সাহায্য করবার বদলে বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত শক্তিগুলো উন্নয়নশীল দেশের কষ্টার্জিত জ্ঞান ও কৌশলে জৈবসম্পদ নিয়ে একপ্রকার অবৈধ ভাবে তাদের নিজেদের নামে ব্যবহার করে উন্নতি লাভ করছে। এর সাথেই ক্রমাগত বেড়ে যাওয়া চাহিদা মেটাতে বিশ্বের বিভিন্ন জীববৈচিত্র উষ্ণবিন্দু (Biodiversity Hotspot) গুলোও এর অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় জীবকূল আজ বিলুপ্ত হতে চলেছে। বেশ কিছু ঔষধি গাছ যেগুলো পেটেন্ট (Patent) এর অন্তর্গত সেগুলো হল — (১) কাভা (Kava) — প্রাকৃতিক প্রাপ্তিস্থান> ফিজি, হাওয়াই, ভানুয়াটু প্রভৃতি ; (২) কুইনোয়া (Quinoa) — প্রাকৃতিক প্রাপ্তিস্থান> আন্দিজ পার্বত্য অঞ্চল (পেরু, বলিভিয়া প্রভৃতি) ; (৩) রোজি পেরিউইঙ্কল (Rose Periwinkle) — প্রাকৃতিক প্রাপ্তিস্থান> মাদাগাস্কার ; (৪) নিম (Neem) — প্রাকৃতিক প্রাপ্তিস্থান> ভারতীয় উপমহাদেশ (ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি)।

♦কিছু গুরুত্বপূর্ণ পেটেন্ট ও সংক্ষিপ্ত ধারণাঃ-
(১) নিমঃ- নিমের ঔষধি গুন বহুবিধ, ভারতীয়রাই নিমের এই বহুমুখী গুণের প্রকৃত উদ্ভাবক। তবে নিমের তেল থেকে যাবতীয় প্রসাধনী ও ঔষধ শিল্পে কাজে লাগানোর পেটেন্ট (Patent) প্রকাশিত হয় নব্বই এর দশকে (No – 0426257B)।
(২) বাসমতি চালঃ- এটিও ভারতীয়দের উদ্ভাবনা, এটি একধরনের সুগন্ধি চাল বিশেষ। ১৯৯৭ সালে US পেটেন্ট ও ট্রেডমার্ক প্রাপ্ত হয় এবং এক আমেরিকান কোম্পানি “Basmati rice lines & grains” নামে এটি অধিকার করে (No – 5663484)।
(৩) আফ্রিকার মিষ্টি বেরি ফলঃ- এই বেরি ফল সাধারণ চিনির তুলনায় 2000 গুন বেশি মিষ্টি যা খুবই কম ক্যালোরি যুক্ত ও প্রোটিন গুন সম্পন্ন যাকে Brazzein বলা হয়। পরবর্তীতে এটি US পেটেন্ট ভুক্ত হয় এবং জিন এনকোডিং-এর মাধ্যমে এই ফল থেকে একধরনের ভুট্টার বীজ তৈরিতেও সফলতা আসে।

Biopiracy মূলত লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যেই গৃহীত হয়ে থাকে। তাই বর্তমান বিশ্বে Biopiracy এক ধরণের অভিশাপ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই আলোচনার প্রসঙ্গে Biopiracy ও Eco-terrorism এই দুটি শব্দ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র তার লাভের হার বাড়াতে কোনো জৈব সম্পদের ওপর তার অধিকার আদায় করেই শান্ত হয় না, বরং তার লক্ষ্য থাকে সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়াটা। তাই জৈব সম্পদ ভালো দিক অর্থাৎ চিকিৎসা ক্ষেত্রে রোগ সারিয়ে তোলার পাশাপাশি Biochemical পদ্ধতিতে রোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন — খাদ্য, জল, বায়ুর মাধ্যমে এই পদ্ধতিতে রোগ ছড়িয়ে গিয়ে ইনফেকশন দেখা দিতে পারে এবং সঠিক প্রতিষেধক ঠিক সময়ে না নিলে তা মহামারীর আকারও ধারণ করতে পারে। US ডিজিজ সেন্টার থেকে প্রকাশিত তালিকায় কিছু বিষাক্ত ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের নাম উল্লেখ পাওয়া যায় যা থেকে Biochemical পদ্ধতিতে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করার মাধ্যমে হামলার ক্ষেত্রে সেগুলো ব্যবহার করা যায় ও লক্ষ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলা সম্ভব। যেমন — এক্ষেত্রে অ্যানথ্রাক্স, স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের উল্লেখ করা যায়, এগুলো প্রতিষেধক দ্বারা ও বাতাসে জীবাণুনাশক ছিটিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও, বর্তমানের কোরোনা ভাইরাস (COVID-19)ও চিনের এরকমই এক মারাত্মক ধরণের Biochemical পদ্ধতিতে তৈরি এক ভাইরাস বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, যা সারা বিশ্বে মহামারীর আকার ধারণ করেছে।
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত তাই Biopiracy -এর নিয়ন্ত্রণ যদি না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তবে এই Biopiracy নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে Convention on Biological Diversity (১৯৯৩), আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের Patent Law এবং Bio Prosprecting Contract উল্লেখযোগ্য।

লেখিকাঃ- ভাস্বতী নাগ (খাগড়াবাড়ি, কোচবিহার)
তথ্যসূত্রঃ- Wikipedia ; Merriam Wesbster Dictionary ; Sildeshare – Biopiracy/Shivang Patel
প্রথম প্রকাশঃ ভূগোলিকা ফেসবুক পেজ, তৃতীয় বর্ষপূর্তি-৩০/০৩/২০২০

©ভূগোলিকা-Bhugolika
©মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

ভাস্বতী নাগ

ঠিকানাঃ খাগড়াবাড়ি, কোচবিহার

One thought on “জৈবদস্যুতা (Biopiracy)

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত