ঝাড়খন্ডের ‘লেডি টারজান’ যমুনা টুডু II ‘Lady Tarzan’ Jamuna Tudu

‘A people without children would face a hopeless future ; a country without trees is almost as helpless’ – আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ২৬তম রাষ্ট্রপতি থিওডোর রুজভেল্টের এই উক্তি বর্তমান পৃথিবীতে বিশ্ব উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। বিশ্ব উষ্ণায়ণের চরম প্রভাব পৃথিবীর যে কয়েকটি দেশে পড়েছে এবং পড়বে, তাদের মধ্যে ভারত অন্যতম। তথাকথিত শিক্ষিত জনসমাজ এবিষয় প্রতিরোধে তাত্ত্বিক জ্ঞানী হলেও, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তাঁদের অগ্রগমন সেভাবে দেখা যায় না। অথচ এই ভারতের তথাকথিত অশিক্ষিত-অল্পশিক্ষিত, উপেক্ষিত, বঞ্চিত আদিবাসী সমাজের একজন নারী আপন প্রত্যয় ও সঙ্কল্পে ‘অরণ্যের রাজ্য’ ঝাড়খন্ডে অরণ্য সংরক্ষণে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি যমুনা টুডু — ঝাড়খন্ডের ‘লেডি টারজান’

যমুনা টুডু
ঝাড়খন্ডের ‘লেডি টারজান’ যমুনা টুডু

সালটা ১৯৮০। ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার রায়রংপুরে এক আদিবাসী কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই বড়ো হয়ে ওঠা। দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৯৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে রায়রংপুর থেকে ১০০ কিমি দূরে ঝাড়খন্ড (পূর্বতন বিহার) রাজ্যের পূর্ব সিংভূম জেলার মুতুরখাম গ্রামের মান সিং টুডুর সাথে বিবাহবন্ধনে বাঁধা পড়েন। মান সিং টুডু পেশায় কনট্রাকটর — গ্রামে গ্রামে বাড়ি তৈরি করেন। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসে আর পাঁচজন গৃহবধূর মতো শুধুমাত্র সংসারে বদ্ধ থাকেননি। শুরু করেন পরিবেশ রক্ষার্থে অরণ্য সংরক্ষণের এক অসাধারণ লড়াই।

যমুনা টুডু
ঝাড়খন্ডের ‘লেডি টারজান’ যমুনা টুডু

১৯৯৮ সালে যমুনা টুডু ৪ জন স্থানীয় মহিলা নিয়ে ‘বন সুরক্ষা সমিতি’ গড়ে তোলেন। শুরুর দিকে বন বাঁচানোর উদ্যোগে তীব্র আপত্তি আসে সাধারণ গ্রামবাসীদের তরফ থেকেই। কারন বন হল জ্বালানি কাঠের উৎস। যমুনা বোঝাতে থাকেন, জ্বালানি হিসেবে ছোটো ডালপালা ব্যবহার করতে, বড়ো গাছ নয়। সেসময় ঝাড়খন্ড (পূর্বতন বিহার) রাজ্যের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে বন-মাফিয়াদের রাজত্ব চলত। বেআইনিভাবে জঙ্গল কেটে প্রভুত মুনাফা অর্জন ছিল বেশ লোভনীয়। বন-মাফিয়াদের কাছ থেকে হুমকি, বাধা পেয়েও থেমে থাকেননি যমুনা। বন্দুকবাজ বন-মাফিয়াদের বিরুদ্ধে লাঠি, তীর-ধনুক, বর্শা হাতেই স্থানীয় মহিলাদের নিয়ে বনরক্ষাতে নেমে পড়েন। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে অরণ্য সংরক্ষণের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। বন-মাফিয়াদের কাছ থেকে যমুনা খুনের হুমকি পেয়েছেন। ২০০৪ সালে চাকুলিয়া শহরে তাঁর বাড়িতে হামলা হয়। ২০০৮ সালে যমুনা ও তাঁর স্বামীর ওপর প্রাণঘাতী হামলা হয়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তাঁরা। তবুও এই অসম সাহসী নারী লড়াই ছাড়েননি। মুতুরখাম গ্রামসংলগ্ন ৮০ একর বনভূমি বাঁচাতে এই বীরাঙ্গনার লড়াই সফল হয়। বর্তমানে বন সুরক্ষা সমিতির ৩০০ টি দল রয়েছে এবং প্রত্যেক দলে ৩০ জন করে সদস্য রয়েছেন যারা আজও বনভূমি বাঁচাতে নিরলস কাজ করে চলেছেন। এখন ঝাড়খন্ড পুলিশ তাঁদের নিয়ে বনরক্ষার কাজ করে।

যমুনা টুডু
ঝাড়খন্ডের ‘লেডি টারজান’ যমুনা টুডু

ঝাড়খন্ড সরকার বর্তমানে যমুনার গ্রামটিকে দত্তক নিয়েছে। শিক্ষা ও জল পরিষেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যমুনার লড়াইয়ে, বর্তমানে তাঁর গ্রামে একটি মেয়ের জন্ম হলে ১৮ টি গাছ এবং একটি মেয়ের বিয়ে হলে ১০ টি গাছ লাগানোর নিয়ম চালু রয়েছে। যমুনা গাছকে ভাই-এর চোখে দেখেন। প্রতিবছর রাখীবন্ধনের দিন তিনি ও তাঁর বন সুরক্ষা সমিতির সদস্যরা গাছে রাখী বাঁধেন।

যমুনা টুডু
ঝাড়খন্ডের ‘লেডি টারজান’ যমুনা টুডু

অরণ্য সংরক্ষণের সাফল্যে স্বীকৃতি স্বরূপ একাধিক সম্মান পুরষ্কার পেয়েছেন যমুনা। ২০১৪ সালে স্ত্রী শক্তি পুরষ্কার, গডফ্রে ফিলিপস সাহসিকতা পুরষ্কার ; ২০১৭ সালে Women Transforming India প্রভৃতি। ২০১৯ সালে ভারত সরকার ঝাড়খন্ডের তাঁর অরণ্য সংরক্ষণের নিরলস উদ্যোগকে সম্মান জানিয়ে পদ্মশ্রী পুরষ্কার প্রদান করে। পদ্মশ্রী সম্মান প্রাপ্তিতে আনন্দিত ৩৯ বছর বয়সী যমুনা বলেন — “আমার দেশ পদ্মশ্রী সম্মানের সাথে আমাকে, আমার কাজকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, আমার কাছে অনুভূতি প্রকাশের কোনো ভাষা নেই।”

যমুনা টুডু
ঝাড়খন্ডের ‘লেডি টারজান’ যমুনা টুডুকে পদ্মশ্রী পুরষ্কার তুলে দিচ্ছেন রাষ্ট্রপতি শ্রী রামনাথ কোবিন্দ

কোনো সন্দেহ নেই, যমুনা টুডুর এই লড়াই এক বহুমুখী লড়াইয়ের মিশেল। তাঁর এই লড়াইতে অরণ্য সংরক্ষণ, নারী পরিবেশবাদ, নারী সশক্তিকরণ — সবকিছু মিলেমিশে রয়েছে। টারজানের মতো এই আদিবাসী নারী আজও নিরন্তর অরণ্য রক্ষার কাজে সচেষ্ট রয়েছেন। তাই তো তিনি ঝাড়খন্ডের ‘লেডি টারজান’। লেখকের তরফে এই মহানায়িকার প্রতি সশ্রদ্ধ প্রণাম ও শুভেচ্ছা রইল।

লেখকঃ- অরিজিৎ সিংহ মহাপাত্র (পার্শ্বলা, বাঁকুড়া)।
তথ্যসূত্রঃ- The Indian Express ; Wikipedia ; Kalinga TV ; The Hindu – Businessline ; The Telegraph ; Manorama Online ; India Today.
©Mission Geography India

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত