প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য নীলগিরি

দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে অবস্থিত নীলগিরি পর্বত প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে এবং পর্যটনে এক সুপরিচিত নাম। নীলগিরি শব্দটি সংস্কৃত শব্দ নীলমগিরি থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যার আক্ষরিক অর্থ নীল পর্বত (Blue Mountain)। ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণে পশ্চিমঘাট পর্বত ও পূর্বঘাট পর্বতের মিলনকেন্দ্র হল নীলগিরি। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্গত নীলগিরি পর্বত প্রধানত তামিলনাড়ুর নীলগিরি জেলাতে অবস্থিত।

নীলগিরি
দোদাবেতা শৃঙ্গের ওপরে

নীলগিরি পার্বত্য অঞ্চল নোয়ার নদী দ্বারা উত্তরে কর্ণাটক মালভূমি থেকে এবং পালঘাট গ্যাপ দ্বারা দক্ষিণে আনাইমালাই ও পালনি পাহাড় থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। নীলগিরি পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ দোদাবেতা, যার উচ্চতা ২৬৩৭ মিটার। এছাড়া নীলগিরি পর্বতে ২০০০ মিটারের বেশি উচ্চতাযুক্ত একাধিক শৃঙ্গ রয়েছে। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য — কোলারিবেতা (২৬৩০ মিটার), মাকুর্ণি (২৫৯৪ মিটার), হেকুবা (২৩৭৫ মিটার), মুত্তুনাড়ুবেতা (২৩২৩ মিটার), তামরাবেতা (২১২০ মিটার) প্রভৃতি। নীলগিরি পার্বত্য অঞ্চলে একাধিক জলপ্রপাত রয়েছে, উদাহরণস্বরূপ বলা যায় — কোলাকাম্বাই ফলস্ (নীলগিরি পার্বত্য অঞ্চলের উচ্চতম জলপ্রপাত), ক্যাথেরিন ফলস্, পাইকারা ফলস্, কলহাট্টি ফলস্ প্রভৃতি। নীলগিরি পার্বত্য অঞ্চলে তিনটি জাতীয় উদ্যান পরস্পর মিলিত হয়েছে — মুদুমালাই জাতীয় উদ্যান, মুকুরথি জাতীয় উদ্যান, সাইলেন্ট ভ্যালি জাতীয় উদ্যান। ভূতাত্ত্বিক ভাবে, নীলগিরি পর্বত আর্কিয়ান যুগে সৃষ্টি হয়েছে। এই অঞ্চলটি প্রধানত রূপান্তরিত শিলা (নিস, চারনোকাইট ও শিস্ট) দ্বারা গঠিত।

নীলগিরি পার্বত্য অঞ্চলটি নীলগিরি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের অন্তর্গত, যা হল ভারতের প্রথম বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ। নীলগিরি পার্বত্য অঞ্চলে ২৭০০+ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ, ১৬০ প্রজাতির ফার্ণ এবং অসংখ্য প্রজাতির অপুষ্পক উদ্ভিদ, মস, ফাঙ্গি, অ্যালগি প্রভৃতি পাওয়া যায়। এই অঞ্চলে প্রাণী প্রজাতির বৈচিত্র্য লক্ষ্যণীয় — বাঘ, হাতি, চিতা, বাইসন, চিতল হরিণ, সম্বর হরিণ, ঢোলে (বন্য কুকুর), শিয়াল, সোনালি শিয়াল, অ্যান্টিলোপ, হায়েনা, মালাবার জায়ান্ট স্কুইরেল, প্যাঙ্গোলিন প্রভৃতি স্তন্যপায়ী ; ভারতীয় পাইথন, কিং কোবরা, নীলগিরি কীলব্যাক প্রভৃতি সরীসৃপ ; ময়ূর, শকুন, হর্ণবিল, পেঁচা প্রভৃতি নানাপ্রকার পাখি দেখা যায়।

নীলগিরি
নীলগিরি মাউন্টেন রেলওয়ে

নীলগিরি পার্বত্য অঞ্চলে ১৮৯৯ সালে স্থাপিত হয় ‘Nilgiri Mountain Railway’। ইউনেস্কো ২০০৫ সালে এটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা দেয়। নীলগিরি পার্বত্য অঞ্চলে প্রায় ৩২ বর্গকিমি এলাকায় প্রতি ১২ বছর অন্তর একবার নীল রঙের কুরিঞ্জি ফুল ফোটে। কুরিঞ্জি একটি গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ এবং এই ফুল ফুটলে মৌমাছির আধিক্য বেড়ে যায়। মূলত জুলাই-নভেম্বরের মধ্যে এই ফুল ফোটে। শেষবার ২০১৮ সালে নীলগিরি অঞ্চলে এই ফুল ফুটেছিল। নীলগিরি অঞ্চলে চা, কফি, বিভিন্ন মশলা, আলু, বাঁধাকপি, গাজর, নানাপ্রকার ফল উৎপাদিত হয়।

নীলগিরি
এমারেল্ড লেক, উটি

দক্ষিণ ভারতের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন অঞ্চল নীলগিরি। সবুজ পাহাড়ি উপত্যকা, জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অরণ্য, জলপ্রপাত ও হ্রদ প্রভৃতি আকর্ষণের কারণে প্রতি বছর এখানে বিপুল পরিমাণে পর্যটক সমাগম হয়। নীলগিরির সবচেয়ে বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র উটি। এছাড়া কুনুর, কোটাগিরি, দোদাবেতা, পাইকারা, মুদুমালাই টাইগার রিজার্ভ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য পর্যটন আকর্ষণ। নীলগিরি পার্বত্য অঞ্চলে একাধিক উপজাতির মানুষ বসবাস করেন। উল্লেখযোগ্য উপজাতি গোষ্ঠীগুলি হল — টোডা, কোটা, কুরুম্বা, ইরুলা প্রভৃতি।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জীববৈচিত্র্য, উপজাতি সংস্কৃতি প্রভৃতির মিশেলে নীলগিরি পার্বত্য অঞ্চল সাধারণ পর্যটক থেকে ভৌগোলিক — প্রত্যেককে হাতছানি দিয়ে ডাকে। প্রকৃতির এই স্বর্গরাজ্যে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা যে কারও জন্য বড়ো প্রাপ্তি।


লেখিকাঃ- দেবিকা হালদার (জলঙ্গী, মুর্শিদাবাদ)
[লেখিকা কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল স্নাতকোত্তর বিভাগের ছাত্রী]
তথ্যসূত্রঃ- Wikipedia ; Encyclopedia of Britannica ; আনন্দবাজার পত্রিকা ; নীলগিরি জেলা প্রশাসন, তামিলনাড়ু ; নীলগিরি ওয়াটার পোর্টাল

©ভূগোলিকা-Bhugolika
©মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

দেবিকা হালদার

লেখিকা কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল স্নাতকোত্তর বিভাগের ছাত্রী

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত