ভারতীয় জনসংখ্যা ভূগোলের পথিকৃৎ অধ্যাপক গুরদেব সিং গোসাল

ভারতীয় জনসংখ্যা ভূগোলের পথিকৃৎ অধ্যাপক গুরদেব সিং গোসাল

♦ব্যক্তিজীবনঃ- ১৯২৭ সালের ১ লা এপ্রিল পাঞ্জাবের রোপার জেলার গোসলান নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন অধ্যাপক গুরদেব সিং গোসাল। পিতার নাম সর্দার হাজারা সিং। পৈতৃক ভাবে তাঁর পদবী সিং কিন্তু কৃষিপ্রধান পাঞ্জাবের তাঁর জন্মভূমি গোসলান গ্রামকে তিনি এতটাই ভালবাসতেন যে তাঁর নামের পদবী হিসেবে তিনি গোসাল শব্দ ব্যবহার করে তাকে তাঁর পদবী হিসেবে গ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকে পাঞ্জাবের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জীবনযাপন করে তিনি সেখানকার জীবন-জীবিকার সাথে একাত্ম হয়ে ওঠেন। তিনি পাঞ্জাবের প্রাচীন গ্রামীণ কৃষিব্যবস্থাকে খুব ভালোবাসতেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা এবং কঠোর নিয়মানুবর্তী মানুষ। প্রতিটি বিষয় তিনি বিচারবিবেচনার মধ্য দিয়ে নিজের মতো করে ব্যক্ত করতেন। সাংসারিক জীবনেও তিনি ছিলেন একাধারে অনবদ্য স্বামী ও পিতা। স্ত্রী বলবন্ত কৌর এর সাথে দীর্ঘ ৬৪ বছর গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করেন। তাঁর দুই কন্যা ও এক পুত্র বর্তমান। এসত্ত্বেও তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক, ভৌগোলিক পথপ্রদর্শক এবং সমসাময়িক ভারতীয় ভূগোলের অন্যতম রূপকার।

♦শিক্ষা-জীবনঃ- স্কুল জীবনের প্রধান শিক্ষক সর্দার বন্ত সিং ছিলেন অধ্যাপক গোসালের এক অন্যতম প্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু। তিনিই উচ্চশিক্ষার জন্য তাঁর প্রিয় ছাত্রকে উৎসাহিত করে লাহোরে যাওয়ার প্রেরণা জোগান। লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে গবেষণার জন্য পাড়ি দেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে তিনি ১৯৫৩-৫৬ সময়কালে বিদগ্ধ আমেরিকান ভূগোলবিদ অধ্যাপক গ্লেন ট্রিওয়ার্থার তত্ত্বাবধানে উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনসংখ্যা ভূগোল বিষয়ে তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। এই সময় তিনি তাঁর অন্যতম শিক্ষক তথা আমেরিকার আরেক খ্যাতনামা প্রতিভাবান ভৌগোলিক রিচার্ড হাটশোর্নের সান্নিধ্যে আসেন এবং তাঁর মতাদর্শে প্রভাবিত হন যা পরবর্তী সময়ে তাঁর জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি অধ্যাপক আর্থার এইচ. রবিনসনের নির্দেশনায় মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যা (Cartography) এর শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ১৯৫৬ সালে প্রথম তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়।

♦কর্মজীবনঃ- ১৯৫০ সালে অধ্যাপক গোসাল শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি লুধিয়ানা গভর্নমেন্ট কলেজে প্রথম ভূগোল বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ সালে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশের তিন বছর পর ১৯৫৯ সালের ২৪ শে এপ্রিল চণ্ডীগড়ে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। এখানে তিনি ২৭ বছর অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। শিক্ষক জীবনে তিনি ছাত্রদের কাছে এতই আদর্শবান ছিলেন, যার ফলে তিনি অচিরেই ‘University Man’ নামে খ্যাত হন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদের সাথে সাথে তিনি ১৯৬৮ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৪ বছর Member of University Senate হিসাবে অতিবাহিত করেন। ১৯৭১ সালে Member of University Syndicate হিসাবে নির্বাচিত হন এবং তাতে ১৯৯০ পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর বহাল থাকেন। তিনি ১৯৬৭-৭২ তে Dean of Student Welfare, ১৯৭৫-৭৬ তে Dean of Alumni Relation, ১৯৭৬-৭৯ তে Dean of Foreign Student, ১৯৮০-৮২ তে Dean of University Instruction, ১৯৮৯-৯২ তে Dean of College Development Council পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্ম জীবনে তিনি তাঁর সহকর্মীদের Geography of Rural Settlement, Agricultural Geography ও Urban Geography বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার অনুপ্রেরণা দিতেন। ১৯৮৭ সালের ৩১ শে মার্চ তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মজীবন থেকে অবসরগ্রহণ করেন। ২০০৫ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘The Prestigious Status of Professor Emeritus’ প্রদানে সম্মানিত করেন।

তাঁর কর্মজীবনে বিদেশের বিভিন্ন জনপ্রিয় জার্নালে তাঁর বিভিন্ন লেখা প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক ট্রিওয়ার্থার নির্দেশনায় তাঁর Ph.D গবেষণাপত্র “A Geographical Analysis of India’s Population” প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ সালে এবং ভারতে ভূগোলের এক স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে ‘জনসংখ্যা ভূগোল’ এর সূচনা হয়। এই সময় পর্যন্ত ভারতের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর বিভাগে পৃথক ভাবে জনসংখ্যা ভূগোল পঠন-পাঠন হত না। তিনি ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অনুপ্রেরণায় ‘বেহেস্ত’ কর্মসূচীতে সেনাবহিনীর সুবিধার্থে চরটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রদান করেন, এগুলি হল — ‘Terrain Evaluation of Punjab Plain’, ‘Punjab Himalayas’, ‘Shimla-Shipki Tract’ ও ‘Rajasthan Border’। Indian Council of Social Science Research, National Development এর তত্ত্বাবধানে তাঁর অন্যতম অবদান হল ‘Survey of Research in Geography’। তিনি ICSSR এর North-Western Regional Center এর প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালে তিনি ‘Association of Population Geographer of India প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৭৮ সালে ‘Population Geography’ নামক জার্নালের সূচনা করেন এবং এর সম্পাদকের পদ অলংকৃত করেন। পাঞ্জাবের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দীর্ঘ গবেষণা চালিয়ে তিনি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, এগুলি হল — ‘Census Atlas of Punjab’, ‘Agricultural Landuse in Punjab’ ও ‘Regional Disparities in Punjab’। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের দ্বারা ICSSR কমপ্লেক্সে ২০০৪ সালের ২৯ শে জানুয়ারী তে ‘Regional Dimension of Population, Agriculture and Environment in India Since 1950s’ নামক সেমিনারে সবুজ বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন এবং দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের প্রস্তাব রাখেন। ভারতীয় ভূগোলের অন্যতম রূপকার গুরদেব সিং গোসাল ২০১৪ সালের ৩ রা জানুয়ারী চিরতরে ভৌগোলিক ক্ষেত্র থেকে বিদায় নেন।

♦পরিশেষঃ- ভারতীয় ভূগোল ঘরানায় অন্যতম সেরা ভৌগোলিক অধ্যাপক গোসাল তাঁর সমগ্র জীবনে ভূগোল সাধনায় বিশেষত, জনসংখ্যা ভূগোলের বিকাশে অনবদ্য অবদান রেখে গেছেন। তিনি একনিষ্ঠভাবে জনসংখ্যা ভূগোলের উন্নতি সাধন ও ভবিষ্যৎ ক্ষেত্র নির্মাণে তাঁর কর্মজীবন অতিবাহিত করেছেন। তাঁর লেখার সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে ভারতীয় জনসংখ্যার বিভিন্ন ক্ষেত্র। তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি হল ‘Geography of soul is the soul of Geography’। তাঁর নিরন্তর গবেষণা এবং নতুন নতুন কর্মপন্থা ভারতীয় গবেষণা বিভাগ এবং প্রশিক্ষণ বিভাগের ক্যানভাসে নতুন রঙ আনে ও জনসংখ্যা ভূগোলের ভবিষ্যৎ দ্বার উন্মুক্ত হয়। ১৯৭৮ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু মূল্যবান লেখা তাঁর সম্পাদনায় ‘Population Geography’ জার্নালে প্রকাশিত হতে থাকে। এদের মধ্যে কয়েকটি হল ‘Overcrowding : A Behavioral Perspective’ (১৯৮৭, J. Mohan) ; ‘Migration As A Phenomenon & Process Of Population Change (১৯৮৭, S. R. Mehta) ; ‘National Capital Region of India : A Case of Metropolitan Growth Management'(১৯৮৮, G. Krishan) ; ‘Population Policy & Five Year Plan’ (১৯৮৯, Chandna) ; ‘Regional Disparities in Demographic Development in India'(১৯৯০, K. N. Dubey) ; ‘Infant Mortility in India’ (১৯৯৬, G.Krishan) ; ‘Development and Population Growth : The Indian Experience (১৯৯৬, Chandna) ইত্যাদি। তাঁর Ph.D গবেষণাপত্র “A Geographical Analysis of India’s Population” প্রকাশের পর ভারতীয় ভূগোলে মানবীয় ভূগোল থেকে জনসংখ্যা ভূগোল স্বতন্ত্র রূপে শাখা হিসেবে বিকশিত হয়। তাঁর এই গবেষণাপত্রের উপর নির্ভর করেই পরবর্তী সময়ে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই কৃতী R. C. Chandna ও Sidhu ১৯৮০ সালে ‘An Introduction to Population Geography’ পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন যা জনসংখ্যা ভূগোলের প্রথম ভারতীয় পাঠ্যপুস্তক হিসাবে প্রকাশিত হয় এবং তাঁরই হাতে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতে প্রথম স্নাতক স্তরে ভূগোলের সতন্ত্র শাখা হিসাবে জনসংখ্যা ভূগোলের পঠনপাঠন আরম্ভ হয়। অর্থাৎ বলা যায় গুরদেব সিং গোসালের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল জনসংখ্যা ভূগোল, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যা তিনি পুষ্ট করেছেন। তাঁর সমস্ত কার্যাবলী পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান করলে অতি সহজেই জনসংখ্যা ভূগোলের শাখা হিসাবে সতন্ত্রতা প্রাপ্তির যথার্থতা উঠে আসে, তাই অধ্যাপক গুরদেব সিং গোসাল কে ভারতীয় জনসংখ্যা ভূগোলের পথিকৃৎ হিসাবে ধরা হয়। এমনকি বলা যায় ‘ভারতীয় জনসংখ্যা ভূগোলের জনক’ হলেন অধ্যাপক গুরদেব সিং গোসাল।

◊লেখকঃ- গোপাল মন্ডল, সহ-সম্পাদক, মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া (চৌবাট্টা, বাঁকুড়া)
◊প্রথম প্রকাশঃ মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া ম্যাগাজিন (তৃতীয় সংখ্যা, ৩০ শে জুন, ২০১৮)
◊দ্বিতীয় প্রকাশঃ ভূগোলিকা ফেসবুক পেজ, দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি-৩০/০৩/২০১৯

◊তথ্যসূত্রঃ- Punjab University ; Hindustan Times ; Economic & Political Weekly ; Worldcat

©Mission Geography India
©ভূগোলিকা-Bhugolika

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত