আর বেঁচে নেই মার্স রোভার “অপরচুনিটি”! জানাল নাসা
মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়াঃ ১৫ বছর ধরে লাল গ্রহে তথ্য সংগ্রহের পর মৃত্যু হলো অপরচুনিটির! নাসা দাপ্তরিক ভাবে মঙ্গলে নিযুক্ত তাদের মার্স রোভার “অপরচুনিটি ” কে মৃত অর্থাৎ সম্পূর্ণ বিকল ঘোষণা করেছে ! বর্তমানে মঙ্গল প্রায় পুরোটায় মরুঝড়ে আবৃত , যা একই বছরের সেপ্টেম্বরে ধারন করা হয়েছে । পৃথিবীর মরুভুমিতে যেমন বালিঝড় হয় একই ভাবে মঙ্গলেও এমন মরুঝড় বিদ্যমান । মঙ্গল এমনিতেই মরুভুমি আর একই সাথে মহাকর্ষ কম হওয়ায় ঝড়ের স্থায়িত্বও বেশি হয় । একেকটি মরুঝড় প্রায় বছরখানেক ধরে স্থায়ী হয় । গত বছরের মে মাসের ৩০ তারিখের হিসেব অনুযায়ী এই ঝড় ৩৫ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার গ্রাস করে নেয় । যা মঙ্গলের ভূপৃষ্ঠের এক চতুর্থাংশ । দুঃখের বিষয় হল মঙ্গলে অবস্থানরত নাসার রোভার অপারচুনিটি এই ঝড়ের কবলে পড়েছিল । মঙ্গলের আকাশ এখন পুরোটায় প্রায় ধুলিকনায় ঢাকা যা সূর্যের আলো আসতে বাধা প্রদান করছে । একইসাথে মঙ্গলে আগত সূর্যালোক পৃথিবীর চাইতে অনেক কম ! অপরচুনিটির ব্যাটারি রিচার্জ না হওয়ার কারনে এটির সাথে পৃথিবীর যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে । নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবের পরিচালক জিম ব্রাইডস্ট্রাইন জানান, মঙ্গলের চলমান মরুঝড় কিছুটা স্তিমিত হলে , অপরচুনিটির নিকট হাজারেরও বেশি রিকভারি কম্যান্ড পাঠানো হয় ! কিন্তু অপরচুনিটির কোন প্রত্যুত্তর পাওয়া যায় নি ! নাসা অপরচুনিটির রিকভারি কম্যান্ড এর জন্য মাসে প্রায় ৫ লক্ষ ডলার খরচ করছে । যা বেশ খরচ সাপেক্ষ ! কিন্তু কোন ভাবে সিগন্যাল না পাওয়ার আশা দেখা দেওয়ায় নাসা কম্যান্ড সিগন্যাল না পাঠিয়ে মিশন সমাপ্ত ঘোষণা করেছে ! ইদানিং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাসার জন্য খুব সামান্য অর্থ বরাদ্দ দেন । আর নাসার তাই অতিরিক্ত অর্থ অপচয়ের সুযোগ নেই ! ভাবা হচ্ছে এটির মঙ্গলের মরুঝড়ের বালির নিচে সলীল সমাধি ঘটবে । এর আগে এর জমজ ভাই স্পিরিটও ২০১০ সালে একই পরিনতির স্বীকার হয়েছে !
২০০৩ সালের এপ্রিলে নাসা এই মজ মঙ্গল অভিযান রোভারগুলিকে উৎক্ষেপণ করে। রোভারদ্বয়ের নাম স্পিরিট (এমইআর-এ) এবং অপরচুনিটি (এমইআর-বি)। ২০০৪ এর জানুয়ারিতে দুটি রোভারই মঙ্গলপৃষ্ঠে অবতরণ করে এবং তাদের জন্য বরাদ্দকৃত সবগুলো কাজ সুন্দরভাবে সম্পাদন করে। প্রকৃতপক্ষে তারা আশাতীত সফলতা লাভ করেছিল। এই অভিযানে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক সত্য উদঘাটিত হয়। রোভার দুটির অবতরণের দুটি স্থানেই কোন এক সময় তরল জলের অস্তিত্ব ছিল বলে জানা গেছে। মঙ্গলের ঝড় সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছে মার্স রিকনিসন্স অরবিটার নামক একটি স্যাটেলাইট ! ২০০৫ সালের ১২ই আগস্ট নাসা এই গ্রহের উদ্দেশ্যে মার্স রিকনিসন্স অরবিটার নামক একটি সন্ধানী যান উৎক্ষেপণ করে। ২০০৬ সালের ১০ই মার্চ এটি মঙ্গলে পৌঁছে। এর উদ্দেশ্য দুই বছর ব্যাপী বৈজ্ঞানিক জরিপ পরিচালনা করা। অরবিটারের মূল কাজ মঙ্গলের বিস্তৃত ভূখণ্ড পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী অভিযানগুলোর অবতরণের জন্য উপযোগী স্থান নির্বাচন করা। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পৃথিবীর সাথে অতি উন্নত মানের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা। অভিযানের যোগাযোগে ব্যবহৃত সংকেতের ব্যান্ডপ্রস্থ আগের সবগুলো অভিযানের সমন্বিত ব্যান্ডপ্রস্থ থেকেও বেশী।
সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহ হচ্ছে মঙ্গল গ্রহ। পৃথিবী থেকে অনেকটা লাল দেখানোর কারণে এর অপর নাম হচ্ছে লাল গ্রহ। মঙ্গল সৌর জগতের শেষ পার্থিব বা পাথুরে গ্রহ। অর্থাৎ এরও পৃথিবীর মত শক্ত ভূ-ত্বক রয়েছে। মঙ্গল গ্রহ আজ হচ্ছে একটা শুকনো হাড়ের মত শীতল মরুভূমি। কিন্তু পুরো গ্রহ জুড়েই স্পষ্টভাবে প্রাচীন সব নদীর উপত্যকাগুলো সংরক্ষিত আছে। পাশাপাশি সেখানে প্রাচীন লেক এবং সম্ভবত সমুদ্রের চিহ্নও আছে। এর ভূ-পৃষ্ঠ কতটুকু খাঁজবিশিষ্ট, সেটা হতে আমরা মোটামুটি একটা ধারণা নিতে পারি যে কখন মঙ্গল গ্রহ আরো বেশি উষ্ণ এবং সিক্ত ছিলো। এই পদ্ধতিটা সংশোধিত হয়েছে আমাদের চাঁদে পদচারণার মাধ্যমে, এবং অ্যাপোলো এর নভোচারীদের মাধ্যমে আনা চাঁদের নমুনার উপাদানসমূহের অর্ধায়ু হতে তাদের তেজস্ক্রিয়তার কাল নির্ণয় করে। যাই হোক, মঙ্গলের ক্ষেত্রে জবাবটা হচ্ছে প্রায় চার বিলিয়ন বছর আগে। কিন্তু চার বিলিয়ন বছর আগের সময়টাতেই তো পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব ঘটছিলো! এটা কি সম্ভব যে সেখানে একই পরিবেশ বিশিষ্ট পাশাপাশি দুটো গ্রহ ছিলো, এবং একটাতে জীবনের উদ্ভব ঘটলেও অপরটায় তা ঘটেনি? নাকি মঙ্গলে সত্যিই প্রাণের উদ্ভব ঘটেছিলো, কিন্তু পরিবেশের রহস্যজনক পরিবর্তনে বিলীন হয়ে গিয়েছিলো? নাকি সেখানে মরূদ্যান কিংবা উদ্বাস্তু জাতীয় কিছু রয়ে গেছে? সম্ভবত ভূ-পৃষ্ঠের তলে, যেখানে এখনো হয়তো কোনো এক প্রকারের প্রাণ টিকে আছে? মঙ্গলের প্রাণ নিয়ে মানুষের কল্পবিলাস কয়েক শতকের !
এইজন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , ইউরোপ, ভারত এবং জাপানের পক্ষ থেকে মঙ্গল অভিমুখে ডজনখানেক নভোযান পাঠানো হয়েছে যার মধ্যে অরবিটার, ল্যান্ডার এবং রোভার সবই ছিল। আর অভিযানগুলোর উদ্দেশ্য ছিল মঙ্গলের ভূত্বক, জলবায়ু এবং ভূতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করা। দুঃখজনক হলেও সত্যি, মঙ্গলে পাঠানো নভোযানগুলোর মধ্যে অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির আগে ব্যর্থ হয়ে গেছে। অনেকগুলো অভিযান ঠিকমতো শুরু করার আগেই স্তব্ধ হয়ে গেছে। মূলত কৌশলগত সমস্যার কারণেই এই ব্যর্থতাগুলোর উৎপত্তি। অধিকাংশের সাথে মাঝপথে যোগাযোগ নষ্ট হয়ে গেছে। যোগাযোগ নষ্টের কারণ জানা যায়নি, অনেকগুলোর কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা এখনও চলছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কয়েকটি জনপ্রিয় উদাহরণের মধ্যে রয়েছে: পৃথিবী-মঙ্গল বারমুডা ট্রায়াংগ্ল, মঙ্গল অভিশাপ, বহুল পরিচিত নাসা ইন-জোক এবং “গ্রেট গ্যালাক্টিক পিশাচ” যা মঙ্গলগামী নভোযান খেয়ে বেচে থাকে।
মঙ্গলের প্রথম ফ্লাই-বাই করতে সমর্থ হয় নাসার মেরিনার-৪। ১৯৬৪ সালে এই নভোযান উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। প্রথম মঙ্গলের ভূ-পৃষ্ঠে অবতরণ করে দুটি সোভিয়েত সন্ধানী যান, মার্স-২ এবং মার্স-৩ । ১৯৭১ সালে উৎক্ষেপিত এই দুটি যানই সোভিয়েত মার্স প্রোব প্রোগ্রাম এর অংশ ছিল। দুঃখের বিষয় হল, অবতরণের মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মাথায় দুটি নভোযানের সাথেই পৃথিবীর মিশন কন্ট্রোলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর ১৯৭৬ সালে শুরু হয় নাসার বিখ্যাত ভাইকিং প্রোগ্রাম । এই প্রোগ্রামে দুটি অরবিটার এবং প্রতিটি অরবিটারের সাথে একটি করে ল্যান্ডার ছিল। দুটি ল্যান্ডারই ১৯৭৬ সালে মঙ্গলের ভূমিতে অবতরণ করে। ভাইকিং যখন ১৯৭৬ সালে মঙ্গলে অবতরণ করেছিলো, সেটি তার বায়ুমণ্ডল শুঁকে দেখেছিলো; খুঁজে পেয়েছিলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মতই অনেক গ্যাসের অস্তিত্ব – যেমন, কার্বন ডাই অক্সাইড। আবার পৃথিবীতে ব্যাপক পরিমাণে পাওয়া যায়, তেমন কিছু গ্যাসের বেশ অভাব ওখানে- যেমন, ওযোন। এর চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, পরমাণুর নির্দিষ্ট প্রকারভেদ, তার আইসোটোপিক গঠন নির্ণয় করা গিয়েছিলো; এবং অনেক ক্ষেত্রেই পৃথিবীতে প্রাপ্ত সমতুল্য পরমাণুদের চেয়ে ভিন্ন আঙ্গিকের আইসোটোপিক গঠন পাওয়া গিয়েছিলো। আমরা মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
Today, we're saying #ThanksOppy as the @MarsRovers mission comes to an end. 6 things to know about our record-breaking, discovery-making, marathon-driving rover, which found that ancient Mars was awash in water… and some of the best images it sent back: https://t.co/ZR7pxBP1ZF pic.twitter.com/2L0gzr4WNJ
— NASA (@NASA) February 13, 2019
অপরচুনিটির মিশন সমাপ্ত সেসে মঙ্গলের মাটিতে আর নাসার দুইটি যান সক্রিয় আছে । একটি আমাদের প্রিয় কিউরিয়াস রোভার ! আরেকটি সদ্য মঙ্গলে পা দেওয়া ইনসাইট ল্যান্ডার ! আসছে বছরে নাসার মার্স-২০২০ রোভার সহ , ইসা ও চীনের দুইটি রোভার মঙ্গলে পাড়ি দেওয়ার কথা আছে ! মঙ্গলে ভালো থেকো অপরচুনিটি ! হয়ত কোন একদিন মর্ত্যবাসীরা মঙ্গলে তোমার মৃতদেহ খুজে নিবে আর ফেরত নিয়ে আসবে ধরণীমাতার বুকে মহাকাশ অভিযানের এক গুরত্বপূর্ণ ফসিল রূপে !
তথ্যসূত্রঃ জ্যোতির্বিদ্যা ও সৃষ্টিতত্ত্ব।
External Link: https://www.cnbc.com/2019/02/13/nasa-rover-opportunity-finally-dies-on-mars-after-15-years.html