নারীবাদ – একটি ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ

নারীর মূল্য নির্ভর করে পুরুষের স্নেহ, সহানুভূতি ও ন্যায়ধর্মের উপরে’

-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

‘নারী’ দেশ, কাল এবং সামাজিক ব্যবস্থা ভেদে সর্বাধিক আলোচিত ও সমালোচিত চরিত্র। পৃথিবীর বুকে সভ্য বা অসভ্য, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত আধুনিক বা আদিসত্ত্বা যাই হোক না কেন মানব সভ্যতার পরম্পরায় নারী অনাদিকাল থেকে সমসাময়িক পর্যন্ত নির্যাতনের কেন্দ্রবিন্দু। এই নির্যাতন কখনো প্রকাশ্যে কখনো বা অলক্ষ্যে। আবার কখনো দৈহিক বা মানসিক। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর সম্মান শুধু বইয়ের পাতায়। শিশু থেকে যুবতী, প্রৌঢ়া থেকে বৃদ্ধা কেউই বাদ যায় না এই এই নির্যাতনের করালগ্রাস থেকে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অন্যতম মূল স্তম্ভ নারী হলেও এক নিদারুণ চাপা আর্তনাদ সেই স্তম্ভের ভীত নড়বড়ে করে দেয় ; শক্ত বাঁধনেও ফাটলের তির্যক রেখা প্রকট হয়ে ওঠে যখন পরাধীনতার বেড়াজালে আবদ্ধ স্বাধীন সত্ত্বার নারী নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে নীরবে সয়ে যায় দুর্নিবার যাতনা।

প্রকৃতি তার নিয়মে নিজস্ব গতিতে বয়ে চলে। কালের বিবর্তনে বিবর্তিত হয় সমাজ, সভ্যতা ও মানসিকতা। উঠে আসে নতুন চিন্তাধারা যা দায়বদ্ধতার আদর্শ বেড়াজালে আরো দৃঢ় হয়। পরম্পরা ছিন্ন করে নতুন আলোর দিশায় প্রকট হয়ে উঠে শুভ চেতনা। প্রত্যক্ষ ধারণা থেকে বিমূর্ত ভাবাবেগগুলো নড়েচড়ে বসে বাস্তবের চিন্তাধারায়। জন্ম হয় নতুন দৃষ্টিভঙ্গির, প্রাসঙ্গিকতার কঠোর মূল্যবোধ।
ভূগোলে নারীবাদ প্রত্যক্ষবাদী দর্শনের এক অন্যতম ফল। সামাজিক অসাম্যের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ ব্যবস্থার বিভিন্ন দিকগুলি পর্যালোচনা প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই ভৌগোলিকেরা স্ত্রী-পুরুষের সামাজিক অবস্থানের প্রতি ঝুঁকে পড়েন, আর সেখান থেকেই উঠে আসে এক চরম অসাম্যতা। দেখা যায় পিতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুনের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে কিভাবে নারী সমাজ তথাকথিত সমাজ ব্যবস্থার পদপিষ্ট। ব্রিটিশ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল ১৮৬১ সালে তার লেখা ‘The Subjection of Women’ (প্রকাশকাল ১৮৬৯) গ্রন্থে নারীদের বৈধ ভাবে বশীভূত করণের বিষয়টিকে ভুল প্রমাণের প্রচেষ্টা করেন এবং নারীবাদের বীজ বপন করেন। যার ফলে সামাজিক অসঙ্গতির প্রকটতা সর্বসমক্ষে চলে আসে। এর প্রায় এক শতাব্দী পর নারী জাতির উপরে ঘটে চলা নিপীড়ন, নির্যাতন ও বৈষম্যের অভিজ্ঞতা থেকে 1970 এর দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় নারীবাদ নিয়ে ভাবনাচিন্তা।
সামাজিক ভূগোলের লিঙ্গ বৈষম্যতা এবং নারীর প্রতি উদাসীন মানসিকতার ক্ষেত্র থেকে উঠে আসা প্রত্যক্ষবাদী ধারণা ‘নারীবাদ’ বর্তমান শতকের এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। ওয়েবস্টারের অভিধানে নারীবাদের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ‘এটি হচ্ছে বিভিন্ন লিঙ্গের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতার তত্ত্ব’ (The Theory of the Political, Economics and Social Equality of the Sexes)। হেইল ব্রুনের মতে, ‘একজন নারীবাদী প্রশ্ন উপস্থাপন করেন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে লিঙ্গ বিন্যাসের তাগিদে এবং সেগুলোর বিন্যাসে কাজ করে চলেন।’
১৮৩৭ সালে ফরাসী দার্শনিক চার্লস ফ্যুরিয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘Feminism’ শব্দটি ব্যবহার করেন। এরপর ১৮৭২ সালে ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডে ‘Feminism’ ও ‘Feminist’ শব্দ দুটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এর এক শতাব্দীর কিছু সময় পর ভূগোলে নারীবাদের বিকাশ ঘটে। ১৯৮৪ সালে Institute of British Geographer এর অন্তর্গত Women and Geography Study Group ‘Geography and Gender’ নামক বই প্রকাশের পর নারীবাদ ভূগোলের ভিত্তি রচিত হয়। ওয়েবস্টারের অভিধানের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে নারীবাদ দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশের তিনটি বিষয় উঠে আসে যথা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট। আর এর ভিত্তিতে আধুনিক পাশ্চাত্য নারীবাদ ধারাকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করে নারীবাদের বিকাশ আলোচনা করা যেতে পারে। নারীবাদ বিকাশের প্রাক্-লগ্নের সূচনা হয় ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ ও বিংশ শতকের প্রথম ভাগে। ১৮০৯ এর দশক পর্যন্ত পৃথিবীর কোন অংশে নারীদের রাজনৈতিক মর্যাদা ছিল না বলা যায়। বিশেষ করে ভোটাধিকার ক্ষমতা থেকে নারী ছিল বঞ্চিত। আর রাজনৈতিক এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াটা ছিল স্বাভাবিক। এই সময়কালে নেদারল্যান্ডের উইলহেলমিনা ড্রুকার (১৮৪৭-১৯২৫) তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ও নারীবাদী সংগঠনের সাহায্যে ভোটাধিকার ও সমান অধিকারের জন্য আন্দোলন শুরু করলে তা ক্রমশ ছাড়িয়ে পড়তে থাকে এবং অবশেষে সাফল্য আসে। ১৮৯৩ সালে নিউজিল্যান্ডের সকল উপনিবেশে নারীদের সক্রিয় রাজনীতির দ্বার উন্মুক্ত হয় ভোটাধিকার প্রদানের মাধ্যমে। আর এর সাথেই পৃথিবীর অন্য দেশেও আন্দোলনের তীব্রতা ছাড়িয়ে পড়ে। ১৮৯৩ সালে অস্ট্রেলিয়াও নিউজিল্যান্ডের পথ অনুসরণ করতে বাধ্য হয়। এর আড়াই দশক পর ব্রিটন ২১ বছর বয়সের সকল নারীর ভোটাধিকার স্বীকার করে নেয়। বিস্ময়ের বিষয় হল ১৭৭০ এর দশকে গড়ে ওঠা স্বাধীন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১৯ সালে ১৯তম সংবিধান সংশোধনীর পর নারী সমাজ ভোটাধিকার লাভ করে এবং এরই সঙ্গে নারীবাদের প্রথম পর্বের অবসান ঘটে বলে বিভিন্ন রাজনৈতিক – ভূগোলবিদ মনে করেন।
‘Never doubt that a small group of thoughtful, committed citizens can change the World.’ — Margaret Mead

সমাজ পরিবর্তনে পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে নারীও সমানভাবে পারদর্শী। নারী শক্তি সমাজের অন্যতম রূপকার, কিন্তু শোষণ ও বিধিনিষেধের বেড়াজালে নারী ছিল অবদমিত। এর থেকে মুক্ত হতে সে সদা তৎপর হলেও যুগ যুগ ধরে নারী শক্তি তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ইতিহাসের আলোকে বিচার করলে প্রথম নারী মুক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে খ্রীষ্ট জন্ম পূর্ব নবম শতকে। এই সময় ব্রিটেনে Queen Guendolen তার স্বামীর বিরুদ্ধে প্রথম নারীশক্তিকে একত্রিত করে। ৩৭৮ খ্রিস্টপূর্বে রোমান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কুইন মাভিয়া বারংবার পরাজিত করেনন। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে Lorenze Avemanay ইক্যুয়েডরে নারীদের পেশা ক্ষেত্রে মর্যাদা ও অধিকারের জন্য নারী শক্তিকে একত্রিত করেন। নারী মুক্তি আন্দোলন যে পৃথিবীর বুকে বারংবার ঘটেছে তা বলা বাহুল্য হবে না। সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত নারী তাদের নায্য অধিকার আদায়ের জন্য ১৯৬০ এর দশক থেকে তাদের আন্দোলন তীব্র করে তোলে। ১৯৭১ সালে সুইৎজারল্যান্ডে নারীমুক্তি আন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করে। ১৯৬০ থেকে ১৯৯০ এই তিন দশকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নারী মুক্তি আন্দোলনের বন্যা বয়ে চলে যা নারীবাদের দ্বিতীয় পর্ব রূপে পরিচিত।

লিঙ্গ নির্ভর প্রথাগত সামাজিক মূল্যবোধের নিরিখে নারীবাদের তৃতীয় পর্বের সূচনা হয় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯০ সালে। এই পর্বে সমস্ত লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণের জন্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বর্তমানে সারা বিশ্বও আন্দোলিত। সমকামিতার অধিকার এবং তার বৈধতাস্বীকৃতি আন্দোলন এই পর্বের অন্যতম ফল যা বর্তমানেও অবিরত। ২০০৩ সালে আফ্রিকার শান্তি রক্ষা বাহিনীর তরফে Leymeh Gbowea এবং Comfort Framan ‘Women of Liberia Mass Action for Peace’ গঠন করেন। Aya Virginie Toure ৪০,০০০ মহিলাকে একত্রিত করেন শান্তিপূর্ণভাবে Laurent Goagbo এর বিরুদ্ধে।
নারীবাদ নিয়ে বিভিন্ন মহলে জলঘোলা ব্যাপক। ফরাসী দার্শনিক সিমেন দ্য বুভ্যুয়ে ১৯৪৯ সালে তার প্রকাশিত ‘Second Sex’ গ্রন্থে মার্কসীয় অস্তিত্ববাদের আলোকে নারীবাদের অনেক প্রশ্নের সমাধান করেন। কিন্তু নারীবাদের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আজও বিবাদ প্রবহমান। বিকশিত হয়েছে নারীবাদের বিভিন্ন শাখার। সামাজিক ভূগোলের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যেমন নারীবাদ সমাদৃত তেমনি পরিবেশগত নারীবাদও বর্তমানে ভূগোলের অন্যতম আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এই ধারা বজায় রেখে তার সুফল কামনায় সমাজের মঙ্গল হলে নারীবাদ খুলে দেবে ভূগোল চিন্তার দুনিয়ায় অন্য এক দরজা।

তথ্যসূত্রঃ- Wikipedia, ভূগোল চিন্তার বিকাশ, ভূগোল চিন্তা ও দর্শন।
লেখকঃ- গোপাল মন্ডল (যুগ্ম সহকারী সম্পাদক, মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া)।
প্রথম প্রকাশ: “ভূগোলিকা” ফেসবুক পেজ,  প্রথম বর্ষপূর্তি-৩০/০৩/২০১৮
©Copyright Mission Geography India.

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত