অধিবর্ষের ইতিকথা (The Story of Leap Year)

সাধারণত ক্যালেন্ডারে প্রতি ৪ বছর পরপর আসে, যদিও ব্যতিক্রম আছে। না, ক্রিকেট/ফুটবল বিশ্বকাপ বা ওলিম্পিক গেমসের কথা বলছি না ; এখানে আলোচ্য বিষয় ‘অধিবর্ষ’ (Leap Year)। আজ ২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০। অর্থাৎ ২০২০ অধিবর্ষ (Leap Year) -এর অধিবর্ষ দিবস (Leap Day/Leap Year Day)। যদিও অধিবর্ষ নিয়ে সাধারণ ধারনা আমাদের প্রায় সকলের আছে, তবুও বিষয়টি সহজভাবে তুলে ধরছি।

সাধারণত ৩৬৫ দিনে আমরা একবছর হিসেব করে থাকি। যে বছর অতিরিক্ত একটি দিন (৩৬৫+১=৩৬৬) ক্যালেন্ডারে যোগ করা হয়, তাকে অধিবর্ষ (Leap Year) এবং ওই অতিরিক্ত দিনটিকে অধিবর্ষ দিবস (Leap Year Day) বলা হয়। ইংরাজি ‘Leap’ শব্দের অর্থ হল — লাফ দেওয়া/অতিক্রম করা/ডিঙিয়ে যাওয়া। বাংলায় অধি একটি উপসর্গ, যা — প্রাধান্য/আধিক্য/উপরি অর্থে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে দুনিয়াতে সর্বাধিক প্রচলিত গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারে কোনো অধিবর্ষের ফেব্রুয়ারি মাসেই এই অতিরিক্ত দিনটি যোগ করা হয়। সাধারণ বছর এবং জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বছরের মধ্যে ভারসাম্য রাখতেই এই বিষয়টির প্রচলন করা হয়। পৃথিবী কর্তৃক সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণের প্রকৃত সময়কাল হচ্ছে প্রায় ৩৬৫.২৫ দিন (৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড)। কিন্তু প্রচলিত গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারে ৩৬৫ দিনে বছর হিসাব করা হয়। এভাবে প্রতিবছর প্রায় ৬ ঘণ্টা সময় হিসাবের বাইরে থেকে যায় ও চার বছরে সেটা প্রায় এক দিনের সমান হয়। এই ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য প্রতি চার বছর পরপর ৩৬৬ দিনে বছর হিসাব করা হয়। এই হিসাব অনুসারে ৪ দিয়ে বিভাজ্য বছরগুলোকে অধিবর্ষ বলা হয়। যেমন — ২০১৬, ২০২০, ২০২৪ সাল অধিবর্ষ। তবে এই নিয়মের ব্যতিক্রম আছে। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরতে একদম নিখুঁতভাবে ৩৬৫.২৫ দিন সময় নেয় না, একটু কম নেয়। তাই দেখা গেছে যে চার বছর পর পর অধিবর্ষ ধরলে প্রতি ৪০০ বছরে ৩ দিন সময় বেশি ধরা হয়ে যায়। এই সমস্যার সমাধানের জন্য যেসব বছর ১০০ দ্বারা বিভাজ্য, কিন্তু ৪০০ দ্বারা বিভাজ্য নয় তাদের অধিবর্ষের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। যেমন — ৪ দ্বারা বিভাজ্য হওয়া সত্ত্বেও ১৯০০ সাল অধিবর্ষ নয়। কারণ এটি ১০০ দ্বারা বিভাজ্য হলেও, ৪০০ দ্বারা বিভাজ্য নয়। এই হিসাব অনুসারে ১৬০০, ২০০০, ২৪০০ সাল অধিবর্ষ, কিন্তু ১৭০০, ১৮০০, ১৯০০, ২১০০, ২২০০, ২৩০০ সাল অধিবর্ষ নয়। পৃথিবীতে প্রচলিত প্রায় সকল প্রধান ক্যালেন্ডারেই ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে অধিবর্ষ বিষয়টি রয়েছে।

বর্তমানে সর্বাধিক প্রচলিত ক্যালেন্ডার হল গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার, যা প্রকৃতপক্ষে পূর্বতন জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সংস্কারকৃত উত্তরসূরী। খ্রীস্টপূর্ব ৪৬ সালে জুলিয়াস সিজার যে নতুন ক্যালেন্ডার প্রস্তাব করেন, তাই জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। খ্রীস্টপূর্ব ৪৫ সাল থেকে এই ক্যালেন্ডার প্রচলিত হয়। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে অধিবর্ষের নিয়ম প্রচলিত ছিল। প্রথমদিকে ৩ বছরে অধিবর্ষ প্রচলিত থাকলেও, ০৪ সাল থেকে ৪ বছরে অধিবর্ষের নিয়ম চালু হয়। অন্যদিকে, ১৫৮২ সালে তৎকালীন পোপ গ্রেগরি ত্রয়োদশ কর্তৃক জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সংস্কারকৃত রূপটিই গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। মূলত খ্রিষ্টীয় উৎসব ইস্টার পালনের তারিখ সঠিকভাবে নির্ধারিত করতে এই সংস্কার করা হয়। এই সংস্কারের মধ্যে অধিবর্ষ সংস্কারও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সংস্কারকৃত গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারে অধিবর্ষ নিয়মে প্রতি ৪০০ বছরে ৩ দিন সময় বেড়ে যাওয়ার ত্রুটি দূর করতে উপরোক্ত ৪০০ দ্বারা বিভাজ্যের নিয়ম চালু করা হয়। অধিবর্ষের এই সংস্কারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন — ইতালির ভেরোনার জ্যোতির্বিদ পিয়েত্রো পিতাতি, ইতালির জ্যোতির্বিদ অ্যালোয়সিয়াস লিলিয়াস, জার্মান গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিদ ক্রিস্টোফার ক্ল্যাভিয়াস।

এ তো গেল অধিবর্ষের বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক দিক। এছাড়াও, বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সমাজসংস্কৃতিতে অধিবর্ষ কেন্দ্রিক অনেক প্রথা প্রচলিত রয়েছে। ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড সহ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে অধিবর্ষ দিবসে ‘লিপ ইয়ার প্রোপোজাল’ বা ‘ব্যাচেলর্স ডে’ নামে একটি জনপ্রিয় রীতি প্রচলিত রয়েছে। এই রীতিতে ২৯ ফেব্রুয়ারি শুধু মহিলারাই বিয়ের জন্য তার সঙ্গীকে প্রোপোজ অর্থাৎ প্রস্তাব দেন। ফিনল্যান্ডে এদিনটিতে কোনো পুরুষ যদি কোনো মহিলার বিয়ের প্রস্তাব গ্রহণ না করেন, তবে পুরুষ কর্তৃক ওই মহিলাটিকে স্কার্টের কাপড় কিনে দেবার রীতি প্রচলিত আছে। আবার, অনেক দেশে অধিবর্ষ দিবসকে অশুভ বলে মনে করে করা হয়। যেমন, গ্রিসে অধিবর্ষ দিবসকে বিয়ের জন্য অশুভ মানা হয়। তাইওয়ানে অধিবর্ষকে বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য অশুভ মনে করা হয়। তাইওয়ানে সেই কারণেই মূলত বিবাহিত মেয়েরা গোটা অধিমাস অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসটিতে বয়স্ক মা-বাবার সঙ্গে থেকে তাঁদের দেখভাল করার রীতি প্রচলিত রয়েছে। এসময় তাইওয়ানে সুস্বাস্থ্য ও সৌভাগ্যের জন্য বয়স্কদের ‘পিগ ট্রটার ন্যুডলস্’ খাবার পরিবেশন করা হয়। স্কটল্যান্ডে অধিবর্ষকে পশুপালনের জন্য খারাপ বলে মনে করা হয়। ১৯৮০ সাল থেকে ফ্রান্সে ‘La Bougie du Sapeur’ নামে একটি সংবাদপত্র শুধুমাত্র অধিবর্ষ দিবসেই প্রকাশিত হয়ে আসছে। এটিই হল পৃথিবীর ‘Least Frequently Published’ সংবাদপত্র। ২০১৬ সালের অধিবর্ষ দিবসে এই সংবাদপত্রের দশম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৮৮ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো ও টেক্সাস সীমানাতে অবস্থিত অ্যান্থোনি শহরকে ওই শহরের চেম্বার অফ কমার্স ‘Leap Year Capital of The World’ বলে ঘোষণা করে। এই ছোট্টো শহরে প্রতি অধিবর্ষ দিবস সাড়ম্বরে উদযাপন করা হয়।

অধিবর্ষ দিবসে অর্থাৎ ২৯ শে ফেব্রুয়ারি যারা জন্মগ্রহণ করেন, তাঁদের ‘Leaping/Leaper’ বলা হয়। সাধারণত প্রতি ৪ বছর পরপর তারা প্রকৃত দিনে জন্মদিন পালনের সুযোগ পেয়ে থাকেন। তবে অধিবর্ষ ব্যতীত অন্যান্য বছরগুলিতে তাঁরা অঞ্চলভেদে ২৮ শে ফেব্রুয়ারি/১ লা মার্চ জন্মদিন পালন করে থাকেন। অধিবর্ষ দিবসে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তির বয়স নির্ণয়ের ক্ষেত্রে দেশভেদে ২৮ শে ফেব্রুয়ারি/১ লা মার্চ কে ধরা হয়। যেমন, ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য এবং হংকং-এ ২৯ শে ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণকারী কোনো ব্যক্তি যখন ১৮ বছর পূর্ণ করেন, তখন ওই বছরের ১ লা মার্চ দিনটিকেই সরকারিভাবে তাঁর জন্মদিন/১৮ বছরের পূর্তি হিসেবে ধরা হয়। তাইওয়ানে এক্ষেত্রে ২৮ শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে সরকারিভাবে ধরা হয়। এবার একনজরে দেখা যাক, ২৯ শে ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ অধিবর্ষ দিবসে বিখ্যাত ব্যক্তিদের জন্ম ও মৃত্যু।

২৯ শে ফেব্রুয়ারিতে জন্মঃ-
১৬৯২ সালে জন বায়রম (ইংরেজ কবি ও শিক্ষাবিদ) ; ১৮৯৬ সালে মোরারজি দেশাই (ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী) ; ১৯২৮ সালে ভ্যান্স হায়নেস (আমেরিকান প্রত্নতাত্ত্বিক, ভূতত্ত্ববিদ) ; ১৯৩৬ সালে জ্যাক রবার্ট লোউসমা (আমেরিকান নভশ্চর) প্রমুখ।

২৯ শে ফেব্রুয়ারিতে মৃত্যুঃ-
১৬০০ সালে ক্যাসপার হেনেনবার্গার (জার্মান ঐতিহাসিক এবং মানচিত্রবিদ) ; ১৭৪৪ সালে জন দেসাগুলিয়ার্স (ফরাসি-ইংরেজ পদার্থবিদ ও দার্শনিক) ; জোহান এসচেনবার্গ (জার্মান ঐতিহাসিক) ; এডওয়ার্ড ফ্রেডেরিক বেনসন (ইংরেজ প্রত্নতাত্ত্বিক) প্রমুখ।

তবে ২৯ শে ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ অধিবর্ষ দিবসে জন্ম ও মৃত্যুর ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন স্কটিশ – অস্ট্রেলিয়ান সেনা, রাজনীতিবিদ এবং তাসমানিয়ার অষ্টম প্রিমিয়ার স্যার জেমস মিলনে উইলসন। ইনি ১৮১২ সালে ২৯ শে ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮৮০ সালে ২৯ শে ফেব্রুয়ারি মারা যান — অর্থাৎ জন্ম ও মৃত্যু দুটোই অধিবর্ষ দিবসে!

লেখকঃ- অরিজিৎ সিংহ মহাপাত্র (পার্শ্বলা, বাঁকুড়া)
তথ্যসূত্রঃ- Wiki ; Evening Telegraph ; দৈনিক জাগরণ ; অমর উজালা ; The Guardian

©মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া
©ভূগোলিকা-Bhugolika

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত