ভারতের দশটি ঐতিহ্যবাহী জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা

ভারতের দশটি ঐতিহ্যবাহী জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা

ভারতে সুপ্রাচীন কাল থেকেই জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। ভারতের বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতিতে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন প্রকার জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। আঞ্চলিক বৈচিত্র্য থাকলেও, সমস্তপ্রকার জল সংরক্ষণ ব্যবস্থার লক্ষ্য একটি — প্রকৃতির এক অমূল্য সম্পদ ‘জল’ এর সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবহার। আসুন দেখা যাক, সংক্ষেপে ভারতের দশটি ঐতিহ্যবাহী জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা —

(১) কুলঃ-

ভারতের দশটি ঐতিহ্যবাহী জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা
চিত্রঃ কুল জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা

কুল (Kul) হল উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহ থেকে গ্রামের অভিমুখে নালা বা খালের মাধ্যমে জল সরবরাহ করে, গ্রামের জলাধারে জল সঞ্চয় ও সংরক্ষণের একটি প্রাচীন ব্যবস্থা। এটি প্রধানত ভারতের হিমাচলপ্রদেশ রাজ্যের স্পিতি উপত্যকা এবং জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের জম্মু অঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে। হিমবাহ থেকে কুল ব্যবস্থা শুরু হয় এবং হিমবাহ গলা জলে ময়লার মিশ্রণ রোধ করতে পাথর ব্যবহার করা হয়। দীর্ঘ নালা বা খালের মাধ্যমে হিমবাহ গলা জল গ্রামের জলাধারে নিয়ে এসে সঞ্চয় ও সংরক্ষণ করা হয়।

(২) বাঁশনলঃ-

ভারতের দশটি ঐতিহ্যবাহী জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা
চিত্রঃ বাঁশনল জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা

বাঁশনল (Bamboo Pipe) হল জল সংরক্ষণ ও জলের সুষ্ঠু ব্যবহারের এক প্রাচীন পদ্ধতি। ভারতের মেঘালয় রাজ্যে এইপ্রকার ব্যবস্থা দেখা যায়। ২০০ বছরেরও প্রাচীন পদ্ধতিতে উচ্চ পাহাড়ি অঞ্চলের ঝরণা ও জলধারার জলকে নিচু অঞ্চলের কৃষিক্ষেত্রে সেচের কাজে লাগানো হয়। বিভিন্ন আয়তনের বাঁশের নলের সাহায্যে এই অতি কার্যকরী ব্যবস্থাটি গড়ে উঠেছে। প্রতি মিনিটে ১৮-২০ লিটার জল বাঁশনলের মাধ্যমে প্রবাহিত হয় এবং বিভিন্ন মাপের বাঁশনল ব্যবহার করে প্রয়োজনমতো কম-বেশি পরিমাণ জল সেচকাজে ব্যবহার করা হয়।

(৩) জোহড়ঃ-

ভারতের দশটি ঐতিহ্যবাহী জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা
চিত্রঃ জোহড় জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা

জোহড় (Johad) হল মাটি ও পাথর দিয়ে অর্ধচন্দ্রাকৃতি চেক ড্যামের সাহায্যে জল সংরক্ষণের এক সুপ্রাচীন ব্যবস্থা। ভারতের রাজস্থান রাজ্যের আলোয়ার জেলাতে এই পদ্ধতি দেখা যায়। এই পদ্ধতিতে ভূপৃষ্ঠস্থ জল সংরক্ষণের পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ ভৌমজল সঞ্চয় বৃদ্ধি পায়। জোহড় এর মাধ্যমে আলোয়ার জেলাতে কৃষিকাজের উন্নতি ঘটেছে।

(৪) জবোঃ-

ভারতের দশটি ঐতিহ্যবাহী জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা
চিত্রঃ জবো জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা

জবো (Zabo) হল পাহাড়ের উচ্চ অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের জলকে পাহাড়ের গায়ে ছোটো ছোটো পুকুরের মতো আকৃতির খননকৃত গর্তের সাহায্যে জলসঞ্চয়ের ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি। এটি ভারতের নাগাল্যান্ড রাজ্যের পার্বত্য অঞ্চলে দেখা যায়। এই ব্যবস্থা একই সাথে কৃষিকাজে সেচ, বন্যপ্রাণী পরিচর্যা ও অরণ্য সংরক্ষণের কাজ করে থাকে। স্থানীয় অঞ্চলে এটি রুজা (Ruza) পদ্ধতি নামেও পরিচিত।

(৫) ইরিঃ-

ভারতের দশটি ঐতিহ্যবাহী জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা
চিত্রঃ ইরি জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা

ইরি (Eri) হল নদী থেকে বা বর্ষার অতিরিক্ত জল জলাধারের মাধ্যমে সঞ্চয়ের পদ্ধতি। এটি ভারতের অন্যতম প্রাচীন জল সংরক্ষণ পদ্ধতি এবং ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে ব্যাপকহারে দেখা যায়। নদী থেকে খালের মাধ্যমে বা পুরোপুরি বর্ষার জল সঞ্চয় করে জলাধারে রাখা হয়। কৃষিতে সেচের কাজে ইরির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ভৌমজল সঞ্চয় বৃদ্ধি, মৃত্তিকা ক্ষয় রোধ প্রভৃতিতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে।

(৬) খাদিনঃ-

ভারতের দশটি ঐতিহ্যবাহী জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা
চিত্রঃ খাদিন জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা

খাদিন (Khadin) হল ভূমির ঢাল অনুসারে বাঁধ নির্মান করে ভূপৃষ্ঠস্থ প্রবাহের জলকে সঞ্চয় ও সংরক্ষণ করার পদ্ধতি। ভারতের রাজস্থান রাজ্যের বারমের ও জয়সলমীর জেলাতে এই ব্যবস্থা দেখা যায়। বৃষ্টিপাতের ফলে ভূপৃষ্ঠস্থ প্রবাহের জলকে ভূমির নিচু ঢালে বাঁধ দিয়ে সঞ্চয় করে রাখা হয়। এর মাধ্যমে কৃষিকাজ করা হয়ে থাকে। কখনো কখনো খাদিন থেকে অল্প দূরে অগভীর কূপ খনন করা হয়। খাদিনে সঞ্চিত জল ভূগর্ভস্থ ভৌমজল সঞ্চয়কে বৃদ্ধি করে এবং অগভীর কূপ থেকে জল পাওয়া যায়।

(৭) বিরদাঃ-

ভারতের দশটি ঐতিহ্যবাহী জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা
চিত্রঃ বিরদা জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা

বিরদা (Virda) হল শুষ্ক অঞ্চলে অবনত ভূমিভাগে অগভীর কূপ খনন করে তা থেকে জল সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রাচীন পদ্ধতি। এটি ভারতের গুজরাট রাজ্যের কচ্ছের রণ এলাকায় দেখা যায়। এই অঞ্চলের মালধারী উপজাতি এই পদ্ধতির উদ্ভাবক। বৃৃষ্টিপাতের ভূপৃষ্ঠস্থ প্রবাহ অনুসরণ করে নিচু, অবনত অঞ্চলে যেখানে মাটির নিচে জলসঞ্চয় বেশি, সেখানে অগভীর কূপ খনন করা হয়। এই অঞ্চলের লবনাক্ত ভৌমজলের চেয়ে বৃষ্টির জল অপেক্ষাকৃত হালকা হওয়ায়, তা উপরেই থাকে এবং স্থানীয় অধিবাসীরা সহজেই সেই জল সঞ্চয় করে থাকে।

(৮) সুড়ঙ্গমঃ-

ভারতের দশটি ঐতিহ্যবাহী জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা
চিত্রঃ সুড়ঙ্গম জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা

সুড়ঙ্গম (Surangam) হল সুড়ঙ্গের মাধ্যমে বৃষ্টিপাতের জল ভূগর্ভে সঞ্চয় ও সংরক্ষণের এক প্রাচীন পদ্ধতি। এটি ভারতের কর্ণাটক ও কেরালা রাজ্যে দেখা যায়। এই পদ্ধতিতে অনুভূমিক কূপের মাধ্যমে জল সংগ্রহ করা হয়। সেচকাজ ও ব্যবহার্য জলের চাহিদা মেটায় সুড়ঙ্গম জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা।

(৯) অহর পায়নেঃ-

ভারতের দশটি ঐতিহ্যবাহী জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা
চিত্রঃ অহর পায়নে জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা

অহর পায়নে (Ahar Pyne) হল নদী থেকে খালপথের মাধ্যমে জল সরবরাহ, সঞ্চয় ও সংরক্ষণের একটি বিশেষ ব্যবস্থা। ভারতের বিহার রাজ্যের দক্ষিণাংশে এটি দেখা যায়। পায়নে হল কৃত্রিম খালপথ এবং অহর হল জলাধার। পায়নের একদিক নদীর সাথে যুক্ত থাকে এবং অন্যদিক অহরের সাথে যুক্ত থাকে। বন্যার সময় নদীর অতিরিক্ত জল নিয়ন্ত্রণে এটি বিশেষ কার্যকরী।

(১০) কুন্ডিঃ-

ভারতের দশটি ঐতিহ্যবাহী জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা
চিত্রঃ কুন্ডি জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা

কুন্ডি (Kundi) হল মাটিতে কূপ খনন করে বৃষ্টির জল সঞ্চয় ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা পদ্ধতি। ভারতের গুজরাট ও রাজস্থান রাজ্যে এটি দেখা যায়। একটি ধারন অববাহিকার নিম্নতম কেন্দ্র অঞ্চলে কূপ তৈরি করা হয়। ময়লা মিশ্রণ রোধে কূপের ওপর আচ্ছাদন দেওয়া হয় এবং কূপের চারিদিকে চুন ও ছাই দিয়ে ছিদ্রপথ বন্ধ করা হয়। পানীয় বা গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত জল হিসেবে কাজে লাগানো হয়।

–অরিজিৎ সিংহ মহাপাত্র (সহযোগী সম্পাদক, মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া)

আরও দেখুন “ভারতের ভূগোলের ১০০টি প্রশ্ন ও উত্তর”

আরও দেখুন “চালু হচ্ছে চার বছরের Integrated B.Ed Course।। অন্যান্য প্রশিক্ষণ কোর্স বন্ধ হতে চলেছে”

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত