আজ ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের জন্মদিন তথা জাতীয় চিকিৎসক দিবস
বিধান পুণ্যাত্মা, তাই জন্মদিনেই চলে গেল।
ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী এবং জগদ্বিখ্যাত চিকিৎসক। চিকিৎসা ক্ষেত্রে তাঁকে সম্মান জানিয়ে প্রতি বছর ১ লা জুলাই তাঁর জন্মদিনে সারা ভারত জুড়ে জাতীয় চিকিৎসক দিবস পালন করা হয়।
১৮৮২ সালের ১ জুলাই বিহারের অন্তর্গত পাটনার বাঁকিপুরে বিধান রায়ের জন্ম হয় ৷ তাঁর বাবার নাম প্রকাশচন্দ্র রায় পেশায় ছিলেন একজন আবগারি পরিদর্শক (Excise Inspector)। তাঁর মা অঘোরকামিনী দেবী একনিষ্ঠ সমাজ সেবী ছিলেন। ছয় সন্তানের মধ্যে সব থেকে ছোট ছিলেন বিধান রায় ।
বিধান রায়ের প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় পাটনা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ৷ তিনি এই স্কুল থেকেই ১৮৯৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করেন ৷ তারপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আই.এ (Intermediate in Arts) পাশ করেন। বিহারের পাটনা কলেজ থেকে তিনি গণিত নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হন ৷ গণিত নিয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করার পরে তিনি শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করেন। দুই প্রতিষ্ঠান থেকেই ডাক এলেও তিনি ডাক্তারি পড়বার সিদ্ধান্ত নেন। বিধান রায় ১৯০১ সালের জুন মাসে পাটনা থেকে কলকাতায় আসেন এবং কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন৷ এখানে পড়াকালীন “Whatever thy hands findeth to do, do it with thy might” এই কথাগুলি তাঁর মনে প্রানে প্রেরণার সৃষ্টি করেছিল যা তিনি আজীবন মেনে এসেছেন৷ এরপর এফ.আর.সি.এস(FRCS) ও এম.আর.সি.পি(MRCP) ডিগ্রি অর্জনের জন্য ইংল্যান্ডের সেন্ট বার্থলোমিউ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার উদ্দেশ্যে বিধান রায় ১৮৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাত্র ১২০০ আমেরিকান ডলার নিয়ে ইংল্যান্ড রওনা দেন৷ তবে একজন এশীয় শিক্ষার্থী হওয়ার কারণে সেন্ট বার্থলোমিউ হাসপাতালের ডিন তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন৷ বিধান রায় হতাশ না হয়ে ডিনের কাছে বারংবার আবেদন পত্র জমা দিতে থাকেন৷ প্রায় ত্রিশ বার আবেদনপত্র জমা দেওয়ার পর কলেজে ভর্তি হওয়ার ছাড়পত্র পান তিনি৷ মাত্র দুই বছর তিন মাসের মধ্যেই তিনি একসাথে দুটি ডিগ্রীই অর্জন করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম এক বিরল কৃতিত্ব। ১৯১১ সালের মে মাসে একই সাথে তিনি রয়্যাল কলেজ অব ফিজিশিয়ানের সদস্য এবং রয়্যাল কলেজ অফ সার্জেনের সহযোগী হিসেবে নিযুক্ত হন৷ সেই বছরই তিনি ভারতে ফিরে আসেন৷
ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের প্রাথমিক কর্মজীবন শুরু হয় প্রাদেশিক স্বাস্থ্যসেবক হিসেবে ৷ এমন কি তিনি নার্স হিসাবেও কাজ করেছেন। অবসর সময়ে তিনি নামমাত্র পারিশ্রমিক নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে প্র্যাকটিস করতেন। কঠোর পরিশ্রম তাঁর জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ৷ এমনকি শুরুর দিকে তিনি পার্ট টাইম ট্যাক্সিও চালাতেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসার পরে তিনি বেশ কিছুদিন কলকাতা মেডিকেল কলেজ এবং তারপরে ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুল এবং কারমাইকেল মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতাও করেছিলেন।
১৯২৫ সালে বিধান রায় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন । তিনি ব্যারাকপুর নির্বাচনী এলাকা থেকে বেঙ্গল আইন পরিষদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ‘রাষ্ট্রগুরু’ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করেন ৷ ১৯২৫ সালের শুরুর দিকে বিধান রায় হুগলীর দূষণজনিত কারণগুলি পর্যালোচনা করে ভবিষ্যত দূষণ রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবেন৷
বিধান রায় ১৯২৮ সালে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটিতে নির্বাচিত হন। বরাবরই তিনি নিজেকে রাজনৈতিক শত্রুতা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন৷ বিধান রায় দক্ষতার সাথে বাংলায় আইন অমান্য পরিচালনা করেন। ১৯৩০ সালে পন্ডিত মতিলাল নেহেরুকে তিনি অনুরোধ করেছিলেন তাঁকে যেন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়। কিন্তু কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিকে বেআইনী সমাবেশ হিসাবে ঘোষণা করা হলে অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে বিধান রায়কে ১৯৩০ সালের ২ আগস্ট গ্রেপ্তার করে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করা হয় ।
১৯৩০ সালে ডান্ডি যাত্রা চলাকালীন কলকাতা কর্পোরেশনের অনেক সদস্যকে কারাবরণ করতে হয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেস বিধান রায়কে কারাগারের বাইরে থাকতে এবং কর্পোরেশনের দায়িত্ব পালনের জন্য অনুরোধ করেছিল। ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার মেয়র হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন৷ কংগ্রেস পার্টি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য বিধান রায়কে প্রস্তাব দেয়। শুরুতে বিধান রায় নিজের পেশা নিয়েই থাকতে চেয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত গান্ধীজির পরামর্শে বিধান রায় ১৯৪৮ সালের ২৩ জানুয়ারী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বিধান রায়ের সব থেকে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের মধ্যে পড়ে চিকিৎসা শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে তাঁর ভূমিকা। বিধান রায় বিশ্বাস করতেন যে স্বরাজ তখনই আসবে যখন জনগণ সুস্থ থাকবে। চিত্তরঞ্জন সেবা সদন, কমলা নেহেরু মেমোরিয়াল হাসপাতাল, ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন (কলেজ) এবং চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতাল এবং যাদবপুর টি.বি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯২৬ সাল থেকে মহিলা ও শিশুদের জন্য চিত্তরঞ্জন সেবা সদন চালু করা হয়েছিল। মহিলারা প্রথমে হাসপাতালে আসতে আগ্রহী ছিলেন না। তবে ডাঃ রায় এবং তাঁর দলের কঠোর পরিশ্রমের ফলে সেবা সদন ক্রমেই সকল শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের মহিলাদের জন্য একটি বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে ৷ তিনি মহিলাদের নার্সিং এবং সামাজিক কাজে প্রশিক্ষণের জন্য একটি কেন্দ্র চালু করেছিলেন। কলকাতার মেয়র থাকাকালীন তিনি বিনামূল্যে শিক্ষা, বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা, উন্নত সড়ক, উন্নত আলো ও জলের সরবরাহ সম্প্রসারণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। বিধান রায় হাসপাতাল ও দাতব্য চিকিৎসালয়গুলিতে অনুদান সহায়তা প্রদানের জন্য একটি কাঠামো স্থাপন করেছিলেন৷ তিনি তাঁর মা অঘোরকামিনী দেবীর নামে হাসপাতাল তৈরীর জন্য তাঁর বাড়ি দান করে দিয়েছিলেন৷
১৯৬১ সালের ৪ই ফেব্রুয়ারী তিনি ভারতরত্ন পুরস্কারে ভূষিত হন ৷ ১৯৬২ সালে বিধান রায়ের সম্মানে বি.সি. রায় ন্যাশনাল অ্যওয়ার্ড ক্যাসেল (B.C. Roy National Award Castle) নামে একটি পুরস্কার চালু করা হয় ৷ ১৯৭৬ সাল থেকে চিকিৎসা, রাজনীতি, বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য এবং চারুকলার ক্ষেত্রে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রতিবছর এই পুরস্কার দেওয়া হয়৷
১৯৬২ সালের ১ জুলাই ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের মৃত্যু হয় ৷ তাঁর মৃত্যু প্রসঙ্গে দেশবন্ধুর স্ত্রী বাসন্তী দেবীর কথাটি স্মরণীয়, ‘বিধান পুণ্যাত্মা, তাই জন্মদিনেই চলে গেল।’ ভগবান বুদ্ধও তাঁর জন্মদিনে সমাধি লাভ করেছিলেন। তাঁর জন্ম (ও মৃত্যু) দিনটি ভারতবর্ষে জাতীয় চিকিৎসক দিবস হিসাবে পালন করা হয়।
লেখকঃ- সম্রাট পণ্ডিত (নবীনাবাগ, পশ্চিম মেদিনীপুর)
[লেখক রিসার্চ স্কলার, উইলিয়াম কেরি ইউনিভার্সিটি, শিলং]
তথ্যসূত্রঃ-(১) আনন্দবাজার পত্রিকা, (২) উইকিপেডিয়া, (৩) www.betterindia.com, (৪) THE TIMES OF INDIA