ছায়াপথের শ্রেণীবিন্যাস

মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া: ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি হল মহাবিশ্বের অন্যতম প্রধান স্থাপনা। ছায়াপথ মহাকর্ষীয় শক্তি দ্বারা আবদ্ধ একটি অতি বৃহৎ সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা যা তারা, আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্যাস ও ধূলিকণা, প্লাজমা এবং প্রচুর পরিমাণে অদৃশ্য বস্তু বা ডার্ক ম্যাটার দ্বারা গঠিত। একটি আদর্শ ছায়াপথে ১০ মিলিয়ন থেকে এক ট্রিলিয়ন পর্যন্ত তারা থাকে যারা সবাই একটি সাধারণ মহাকর্ষীয় কেন্দ্রের চারদিকে ঘূর্ণায়মান। বিচ্ছিন্ন তারা ছাড়াও ছায়াপথে বহুতারা ব্যবস্থা, তারা স্তবক এবং বিভিন্ন ধরনের নীহারিকা থাকে। অধিকাংশ ছায়াপথের ব্যস কয়েকশ আলোকবর্ষ থেকে শুরু করে কয়েক হাজার আলোকবর্ষ পর্যন্ত এবং ছায়াপথসমূহের মধ্যবর্তী দূরত্ব মিলিয়ন আলোকবর্ষের পর্যায়ে। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিয়েছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি। এরপর প্রায় ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, মহাবিশ্বের সকল গ্রহ-নক্ষত্র একটিমাত্র গ্যালাক্সিতেই রয়েছে। পরবর্তী সময়ে এডুইন পাওয়েল হাবল তাঁর মহাকাশ পর্যবেক্ষণের সূত্রে জানান যে, ছায়াপথ একটি নয়। বরং আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথ অসংখ্য ছায়াপথের মতো পৃথক একটি ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি। ছায়াপথের গঠন ও বিবর্তন নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা আছে। নক্ষত্র, নীহারিকা বা ব্ল্যাকহোলদের যেমন প্রকারভেদ আছে ঠিক তেমনি ছায়াপথ বা গ্যালাক্সিদেরও প্রকারভেদ রয়েছে।

অনেকেই জানেন যে ছায়াপথ মূলত তিন ধরনের — সর্পিল ছায়াপথ (Spiral Galaxy), উপবৃত্তাকার ছায়াপথ (Elliptical Galaxy) ও অনিয়মিত আকৃতির ছায়াপথ (Irregular Shaped Galaxy)। ছায়াপথের প্রকারভেদ সম্পর্কে প্রথম বর্ণনা করেন এডউইন হাবল। তিনি টিউনিং ফর্ক বা সুরশলাকার আকারের ছকে এই প্রকারভেদ প্রকাশ করেন। আর তাই তার সম্মানার্থেই এই ছককে The Hubble Tuning Fork নামে ডাকা হয়। চিত্রে হাবল সুরশলাকা নকশা দেখানো হয়েছে। হাবল টিউনিং ফর্কের মুলত তিনটি ভাগ। বাম পাশের একক হাতলের মত অংশ দ্বারা উপবৃত্তাকার ছায়াপথ শ্রেণীবিভাগ ও ডানপাশের সুরশলাকার ‘U’ আকৃতির অঞ্চল দ্বারা কুণ্ডলিত বা সর্পিল ছায়াপথদের শ্রেণীবিভাগ বোঝানো হয়েছে। ১৯২৬ সালে হাবল এই ছক প্রকাশ করলেও এখনও ছায়াপথদের শ্রেণীকরণে তা অনুসরন করা হয়।
হাবল তার নিজস্ব পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে উপবৃত্তাকার ছায়াপথদের উৎকেন্দ্রিকতার ভিত্তিতে উপবৃত্তাকার আকৃতি পর্যবেক্ষণ করে ০ থেকে ৭ এর স্কেলে শ্রেণীকরন করেন। শূন্য স্কেলে থাকা ছায়াপথগুলি একদম বৃত্তাকার আকৃতির। পক্ষান্তরে ৭ স্কেলে থাকা ছায়াপথগুলি অত্যধিক উপবৃত্তাকার আকৃতির। অর্থাৎ ৭ স্কেলে থাকা ছায়াপথগুলি হল সবচাইতে উপবৃত্তাকার আকৃতির। একটি উপবৃত্তাকার ছায়াপথের স্কেলের অবস্থান যত বেশি সেই গ্যালাক্সি তত বেশি উপবৃত্তাকার। E-০ দ্বারা বোঝানো হয় ছায়াপথটি উপবৃত্তাকার শ্রেণীর কিন্তু এদের উপবৃত্তাকার আকৃতি চোখে পড়ার মত নয়, বা সহজ অর্থে বৃত্তাকার। E-৭ দ্বারা বোঝানো হয় ছায়াপথটি বেশি উপবৃত্তাকার। তেমনি E-৪ আকৃতির ছায়াপথ হল একদম সঠিক ডিম্বাকৃতির।
ডান পাশের ছায়াপথরা হল সর্পিল বা কুণ্ডলিত ছায়াপথ (Spiral Galaxy)। এদের সর্পিল বা কুণ্ডলিত বাহু থাকে, তাই এমন নামকরন করা হয়েছে। বাহুগুলির সন্নিবেশের উপর ভিত্তি করে সর্পিল ছায়াপথদের ৩ ভাগে ভাগ করা হয়। a, b, c — দ্বারা এই তিন ধরনের সর্পিল ছায়াপথ বোঝানো হয়। a দ্বারা বোঝানো হয় ছায়াপথটির কুণ্ডলিত বাহুগুলি ঘনভাবে সন্নিবেশে অবস্থান করছে। পক্ষন্তরে c দ্বারা বোঝানো হয় ছায়াপথটির কুণ্ডলিত বাহুগুলি একে অপরের থেকে বেশ দূরে অর্থাৎ ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করছে। আর b দ্বারা বোঝানো হয় কুণ্ডলিত বাহুগুলি খুব ঘনভাবেও অবস্থান করছে না আবার খুব দূরে দূরেও অবস্থান করছে না। তবে সব সর্পিল ছায়াপথের কেন্দ্রেই চাকতির মত উজ্জ্বল অংশ থাকে যাকে বালগ্ (Bulge) বলা হয়। অনেকে একে গ্যালাক্টিক কোরও বলে থাকেন। সর্পিল ছায়াপথদের কুণ্ডলীর সন্নিবেশের উপর ভিত্তি করে তাই Sa, Sb, Sc দ্বারা প্রকাশ করা হয়। আশাকরি আর এগুলো ভেঙ্গে বলতে হবে না, বুঝেই গেছেন ব্যাপারটা।
সর্পিল ছায়াপথদের শ্রেণীবিভাগে দুইটি উপশ্রেণী আছে — একটি হল সাধারন সর্পিল ছায়াপথ আর একটি বারযুক্ত সর্পিল ছায়াপথ। বারযুক্ত নামকরন এর কারন হল অদ্ভুত এক বারের জন্য। চিত্রের টিউনিং ফর্কের ডান পাশের নিচের অংশ দ্বারা বারযুক্ত সর্পিল ছায়াপথ বা Barred Spiral Salaxy দের বোঝানো হয়েছে। বারযুক্ত সর্পিল ছায়াপথের কেন্দ্র বরাবর একটি লাইন (Line/Bar) থাকে যেখানে নক্ষত্র ও গ্যাস ঘন অবস্থান করে। আর এদের এমন অবস্থান ও ঘনভাবে অবস্থিত নক্ষত্রদের আলোর জন্য ছায়াপথের মাঝের অংশটি লম্বা বারের মতো মনে হয় বলে এদের এরূপ নামকরন করা হয়েছে। সর্পিল ছায়াপথের দুই-তৃতীয়াংশ ছায়াপথই বারযুক্ত সর্পিল ছায়াপথ। ছায়াপথগুলোর বারযুক্ত অঞ্চলটি এর জীবন প্রবাহ (Life Channel) হিসেবে কাজ করে। চ্যানেলটির মাধ্যমে নক্ষত্র উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস ও ধুলিকনা এর কেন্দ্রে পরিবাহিত হয়।আবার নতুন জন্ম নেওয়া নক্ষত্রগুলি তাদের কৌণিক ভরবেগের (Angular Momentum) দরুন এই বার আকৃতির চ্যানেল দিয়েই কেন্দ্র ত্যাগ করে। আবার এর কেন্দ্রের দানবাকৃতি ব্ল্যাকহোলের (Supermassive Blackhole) খাদ্য পরিবহণের রাস্তা হিসেবেও এই চ্যানেল ব্যবহার হয়। তবে সুন্দর এই ছায়াপথগুলোসাধারন সর্পিল ছায়াপথদের পূর্বে উল্লেখিত Sa, Sb, Sc দ্বারা প্রকাশ করা হলেও বারযুক্ত সর্পিল ছায়াপথ বা Barred Spiral Galaxy দের নামকরনে একটি অতিরিক্ত বড় হাতের ‘B’ যোগ করা হয়েছে। এদের SBa, SBb, SBc দ্বারা প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ মাঝের এই B দ্বারা নির্দেশ করা হয় যে এদের বার আছে। SBa দ্বারা বোঝানো হয় ছায়াপথটির বার আছে ও ছায়াপথটির কুণ্ডলিত বাহুগুলি ঘনভাবে সন্নিবেশে অবস্থান করছে। SBc দ্বারা বোঝানো হয় ছায়াপথটির বার আছে ও ছায়াপথটির কুণ্ডলিত বাহুগুলি দূরে দূরে অবস্থান করছে। SBb দ্বারা কি নির্দেশ করা হচ্ছে তা নিজেরাই বার করে ফেলুন। আমাদের আকাশগঙ্গার বার আছে এবং একইসাথে এটির কুণ্ডলিত বাহুগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছ। তাই একে SBc শ্রেণীতে রাখা হয়েছে। আমাদের ছায়াপথে ১০০ বিলিয়ন (মতভেদে ৪০০ মিলিয়ন) নক্ষত্র আছে।
চিত্রে আরেকটি উপশ্রেণী আছে, যা হয়তো অনেকে বুঝতে পারছেন না। টিউনিং ফর্ক ও হাতলের মাঝে S0 নামে আরেক শ্রেণীর ছায়াপথ আছে। এদের লেন্টিকুলার ছায়াপথ (Lenticular Galaxy) বলা হয়। এই শ্রেণীর ছায়াপথরা না উপবৃত্তাকার আর না সর্পিলাকার। এদের আকৃতি দেখে এদের পৃথকীকরণ করা যায় না। তাই এদের S0 টাইপে রাখা হয়েছে। আর এবড়ো খেবড়ো, হরেক রকম আকৃতির, বামন ছায়াপথ, পুঁচকে স্যাটেলাইট ছায়াপথ ও দানব উপবৃত্তাকার ছায়াপথদের এই টিউনিং ফর্ক ছকে রাখা হয় নি। তাই The Hubble Tuning Fork এর বাইরের শ্রেণীভুক্ত ছায়াপথদের অনিয়মিত আকৃতির ছায়াপথ বলা হয়। অনেকে সর্পিল ছায়াপথদের বিবর্তনকে Sa/SBa থেকে Sc/SBc দ্বারা উল্লেখ করেন। অর্থাৎ Sa/SBa থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে Sc/SBc ছায়াপথে পরিণত হয়। আরেক অর্থে Sa/SBa হল প্রথম প্রজন্মের ছায়াপথ।
উল্লেখ্য, ছায়াপথ কেন্দ্রীণ বা গ্যালাক্টিক কোর (Galactic Core) হল যে কোনো ছায়াপথের কেন্দ্র (Centre of Galaxy)। অনেকে একে গ্যালাক্টিক সেন্টারও বলে থাকেন। কোনো ছায়াপথ তার অন্তঃস্থ যে অঞ্চলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত (Rotate) হয় সেটিই হল ছায়াপথ কেন্দ্রীণ গ্যালাক্টিক কোর। সাধারনত সর্পিল ছায়াপথের (Spiral Galaxy) সর্পিল বাহুগুলি এই কেন্দ্রীণ থেকেই উৎপন্ন হয়।তবে যে কোন ছায়াপথের নক্ষত্রগুলি এই কেন্দ্রীণকে ঘিরেই প্রদক্ষিণ করে। এই অঞ্চলটিতে প্রচুর পরিমান ঘন গ্যাস ও ধূলিকনা বিদ্যমান থাকে। উপবৃত্তাকার (Elliptical) ও সর্পিল (Spiral) ছায়াপথগুলোর কেন্দ্রে দানব ব্ল্যাকহোল থাকে। ছায়াপথের কেন্দ্রীণে (Core) সাধারনত বৃদ্ধ অত্যুজ্জ্বল দানব শ্রেণীর নক্ষত্র থাকে। উপস্থিত ব্ল্যাকহোলটির অতীব মাধ্যাকর্ষণের ফলে উপস্থিত গ্যাস বা ধূলিকনা থেকে নতুন নক্ষত্র জন্ম নিতে পারে না। দানবটি গ্যাস ও ধূলিকনা গিলতে থাকে। কিছু কিছু ছায়াপথের কেন্দ্রে মহাকাশের সবচাইতে উজ্জ্বলতম বস্তু কোয়েজার (Quaser)ও উপস্থিত থাকে।কোয়েজার হল একশ্রেণীর ব্ল্যাকহোল যাদের ঘটনা দিগন্তে গ্যাস বা অন্য কোন পদার্থ প্রবেশ করলে সংঘর্ষের ফলে জেট আকারে কণা নির্গত হয়।

লেখকঃ- ওয়েস আল কারণী (জ্যোতির্বিদ্যা ও সৃষ্টিতত্ত্ব)
তথ্যসূত্রঃ- Wikipedia ও Spacetelescope
প্রথম প্রকাশ: ‘ভূগোলিকা’ ফেসবুক পেজ, প্রথম বর্ষপূর্তি-৩০/০৩/২০১৮

©Mission Geography India.

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত