ড্যাম্পিয়ার-হজেস রেখা: সুন্দরবনের অজানা এক আঙ্গিকে আলোকপাত

সুন্দরবন শব্দটা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে হাতছানি দেয়, কুয়াশাবৃত বাদাবন, তার ছোট ছোট বেনামী খাঁড়ির মধ্যে সভ্যতার গুটিকয়েক প্রতিনিধি হিসেবে, রাতভর ভেসে থাকা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মউলে, বাউলে, হালিয়াদের নৌকা (উল্লেখ্য বিষয় হলো, সুবিস্তৃত সুন্দরবনে একাধিক জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি, স্থান ও উপভাষার প্রকারভেদে, এই জীবিকাধারণের নাম বদলে যায়। এক্ষেত্রে, সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত নামগুলোর ব্যবহার করা হয়েছে), গরাণ-কেওড়া-বায়েনের বুক চিরে বেরিয়ে আসা ডোরাকাটা বা চিতল হরিণ, অথবা খাঁড়ির জলে ডুব সাঁতার দেওয়া সুবিশাল কুমীর। কিন্তু এই অজানায় ভরা সুবিশাল ভূখন্ড ও বদ্বীপ অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক, আর্থসামাজিক অথবা জীববৈচিত্র্যর ইতিহাস সম্পর্কে আমরা কতজনই বা ওয়াকিবহাল। ভ্রমণপিপাসু বাঙালিকে সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্থল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেই, পটাপট উত্তর পাওয়া যাবে — গদখালি হোক বা সামশেরনগর, ঝড়খালি হোক বা দয়াপুর, প্রত্যেকটা জায়গাই তার ঠোঁটস্থ। আবার কোন খালে ঢুঁ মারলে নিশ্চিত ভাবে পাওয়া যাবে মামার দর্শন, তা বলবার লোকের অভাব হবে না। কিন্তু এই সুন্দরবন আজ থেকে বেশ কয়েক’শ বছর আগে ঠিক কেমন ছিল তা জানতে গেলে, আমাদের কিন্তু সুন্দরবনের ইতিহাস সম্পর্কে পড়তেই হবে। আজকের এই প্রবন্ধের প্রধান লক্ষ্য, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ইতিহাস ও তার লাগোয়া প্রেক্ষাপটের উপর খানিকটা আলোকপাত করা। আর সেই লক্ষ্যে এগোতে গেলেই, সর্বপ্রথম জানতে হবে Prinsep’s Line (প্রিন্সেপের রেখা) বা Dampier-Hodges Line (ড্যাম্পিয়ার-হজেস রেখা) সম্পর্কে।

ব্রিটিশ শাসনের পূর্ববর্তী, সময়ে সুন্দরবনের ইতিহাস, বিশেষ করে সেখানে জনমানবের আগমন ও তৎপরবর্তী বসবাস সম্পর্কে খুব একটা সুস্পষ্ট ছবি আমাদের কাছে নেই। তবে সুন্দরবনে এককালে যে সুসংহত মানবসভ্যতার অস্তিত্ব ছিল, তার প্রমাণস্বরূপ, নিম্নে উল্লেখিত, কয়েকটি প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ দেওয়া হলো, যথা —
(১) উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বাদুড়িয়ার কাছে চন্দ্রকেতুগড়ের ধ্বংসাবশেষ ও তার সাথে প্রাচীন গ্রীক ভূগোলবিদ টলেমি দ্বারা উল্লেখিত ‘গঙ্গারিদাই’-এর সম্ভাব্য যোগ।
(২) দক্ষিণ ২৪ পরগণার রায়দীঘির দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত, কঙ্কনদীঘির সুপ্রাচীন ও অক্ষত ‘জটার দেউল’, ও দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত দীঘিরপাড়-বকুলতলায় আবিষ্কৃত লক্ষ্মণ সেনের তাম্রশাসন।
(৩) দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলারই পাথরপ্রতিমার নিকটবর্তী রাক্ষসখালী দ্বীপে আবিষ্কৃত মাটির শিলমোহর ও জ্ঞানপালের তাম্রশাসন।
(৪) দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার জয়নগরের নিকটবর্তী বাইশহাটা গ্রামে আবিষ্কৃত ইঁটের স্তুপ। মোটামুটিভাবে, এই বিক্ষিপ্ত আবিষ্কারগুলো সুন্দরবনের প্রাচীনকাল সম্পর্কে আমাদের খানিকটা ধারণা দিতে পারে। মনে করা হয় যে, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিকম্পের মতো একাধিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুহুর্মুহু হানাদারির ফলে, সুন্দরবনে মানবসভ্যতার পতন হয়।

পরবর্তীকালে, মধ্যযুগে সুন্দরবনের খাঁড়ি অঞ্চলে মগ, আরাকান ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের প্রকোপ বাড়তে থাকে। কিছু কিছু সূত্র অনুসারে, এইসব জলদস্যুদের উৎপাত ও পারিপার্শ্বিক একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সুন্দরবন জনশূন্য হতে আরম্ভ করে। ফলস্বরূপ, সুন্দরবনের উত্তরমুখী শ্রীবৃদ্ধি। এবং সেই শ্রীবৃদ্ধির মাত্রা এতটাই, যে ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে, যখন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার জমিদারি প্রথা প্রণয়নের অধিকারের ‘দেওয়ানি’ প্রাপ্তি করে, তখন নাকি, তৎকালীন কলকাতার মাত্র ৭ মাইল পূর্বে সুন্দরবনের সীমারেখা অবস্থান করতো। আর এর জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ হল, যে আজও কলকাতার পূর্বাংশে সল্টলেক, রাজারহাট বা নলবন লাগোয়া অঞ্চলে, সুন্দরবনের আরাধ্যা দেবী, বনবিবি মায়ের শতাব্দী প্রাচীন মন্দিরগুলোর উপস্থিতি। লোকমুখে শোনা যায় যে, বর্তমান কলকাতার বৈষ্ণবঘাটা-পাটুলী উপনগরী পর্যন্ত নাকি সুন্দরবন প্রসারিত ছিল। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, খাস কলকাতার গরাণহাটা স্ট্রীট বা কেওড়াতলা অঞ্চলের নামের মধ্যে, যথাক্রমে, গরাণ ও কেওড়ার উল্লেখ আছে, এবং দুটো গাছই কিন্তু বাদাবনের গাছ বলে সুপরিচিত। আবার কেউ কেউ মনে করেন কালীঘাট-চেতলা অঞ্চলে, আদিগঙ্গার পাড়ের কুখ্যাত ব্যাঘ্রসঙ্কুল অরণ্যও সুন্দরবনের উত্তর বাহুর একটা অংশবিশেষ ছিল। তবে সুন্দরবনের এই অঞ্চলগুলো ছিল Freshwater swamps, অর্থাৎ মিষ্টিজলের জলাভূমি, যা আজ বিলুপ্তপ্রায়। আবার কোনো কোনো জলাভূমির সাথের খাঁড়ির যোগাযোগ থাকার দরুন, বঙ্গোপসাগরের লবণাক্ত জল, জোয়ার ভাটার মাধ্যমে সেই সব জলাভূমিতে প্রবেশ করত, ফলতঃ সেগুলো হতো লবণাক্ত জলাভূমি। আজকের সল্টলেক বা লবণহ্রদ উপনগরী বা বিধাননগর কিন্তু এরকম কিছু লবণাক্ত জলাভূমির উপর নির্মিত।

ফেরা যাক আসল কথায়। জনবিরল সুন্দরবনকে, অর্থ উপার্জনের বিপুল সম্ভাবনাময় অঞ্চল হিসেবে পুনরুদ্ধার করার সম্ভবতঃ প্রথম সরকারী প্রচেষ্টাটি করেন, ১৭৭০ খৃষ্টাব্দে তৎকালীন ২৪ পরগণা জেলার প্রথম জেলাশাসক ক্লড রাসেল। যেহেতু তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের রাজপাট নিয়ন্ত্রণ হতো কলকাতা থেকে, তাই সেই শহরের নিকটবর্তী সুন্দরবন-ভুক্ত অঞ্চলগুলোতে চাষবাস ও জনবসতি গড়ে তোলাই ছিল তার প্রাথমিক লক্ষ্য। তারই অংশ হিসেবে, তিনি সুন্দরবনের জমি Lease বা ইজারা হিসেবে প্রদান করা শুরু করেন। শর্তও ছিল খুব সামান্য, প্রথমে খানিকটা সময় এই ইজারার কোনো মূল্য সরকারকে দিতে হবে না। পরবর্তীকালে সেই জমি কৃষিযোগ্য হয়ে উঠবার পর, সেই জমির পর্যবেক্ষণ করে তার মূল্য তৎকালীন ১ থেকে ৮ টাকা প্রতি একর দরে ধার্য হবে।
প্রথমদিকে, এই ব্যাপারটি বেশ জনপ্রিয় হয়। ১৭৮৫ খৃষ্টাব্দ অবধি প্রায় ১৫০ জন ইজারাদারের ইজারাপ্রাপ্তি হয়। কিন্তু পরবর্তীতে, ব্রিটিশ সরকার ও ইজারাদারদের মধ্যের কলহ ও এই ভূখণ্ডের দূর্গমতার ফলে, মাত্র ১৬ জন ইজারাদার ব্যতিরেকে বাকি সকল ইজারাদাররা তাদের ইজারা ফেরৎ দিয়ে দেন। আবার ১৮১০ খৃষ্টাব্দের আশেপাশে, সাগরদ্বীপ পুনরুদ্ধার ও ডায়মন্ড হারবারে বন্দর স্থাপনের উদ্যোগ গৃহীত হয়। অতএব, এইসব তথাকথিত উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ ও তাদের সফল রূপায়ণের লক্ষ্যে, সুন্দরবন অঞ্চলের সর্বেক্ষণ (Survey) অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্য হয়ে ওঠে। কিন্তু এই দুর্গম, দুর্ভেদ্য বনাঞ্চল, যার অধিকাংশই হিংস্র পশু ও রক্তলোলুপ জলদস্যু দ্বারা পর্যবসিত, তার সর্বেক্ষণ করা মুখের কথা ছিল না। এই সুবিশাল কর্মকান্ড বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ধাপে সম্পাদিত হয়। নিম্নে সেগুলো তুলে ধরা হলো।
(১) ১৮১১ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৮১৪ খৃষ্টাব্দ, লেফটেন্যান্ট ডব্লিউ. এ. মরিসন (Lt. W. A. Morrieson) প্রথমবার সুন্দরবন সর্বেক্ষণ করেন। পশ্চিমে হুগলি নদী থেকে শুরু করে পূর্বে পশুর নদ (বর্তমান বাংলাদেশের অংশ) পর্যন্ত তিনি এই সর্বেক্ষণ কার্য চালনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে একটা বড় সময়কাল পর্যন্ত, তাঁর নির্মিত এই মানচিত্রগুলো সুন্দরবনের প্রশাসনিক মানচিত্র হিসেবে গণ্য হয়েছে। তবে তিনি বঙ্গোপসাগরের তটরেখা সংলগ্ন বনাঞ্চলের সর্বেক্ষণ করেননি। পরবর্তীকালে তার ভাই, ক্যাপ্টেন হুঘ মরিসন (Captain Hugh Morreison) এই মানচিত্রের বিশুদ্ধিকরণ করেন। এর ঠিক পরে পরেই, ১৮১৬ খৃষ্টাব্দে পাস হয় ‘Regulation IX of 1816’, যার মাধ্যমে সমগ্র সুন্দরবনকে আনা হয় ‘কমিশনার ইন দ্য সুন্দরবন্স’ এর প্রশাসনিক ছত্রছায়ায়; ক্ষমতাবলে একজন সুন্দরবন কমিশনার ছিলেন তৎকালীন জেলাশাসকের সমতুল্য।
(২) এরপর ১৮২১ সালে সুন্দরবন কমিশনারের পদাধিকার পুনর্বিন্যস্ত হয়। ততদিনে বেশ কিছু ইজারাদার, অরণ্য বিনষ্ট করে, চাষযোগ্য জমি উদ্ধার হেতু, দক্ষিণ পূর্বে ক্যানিং ও দক্ষিণ পশ্চিমে কাকদ্বীপ পর্যন্ত অগ্রসর করে গিয়েছেন। এর ঠিক পরেই ১৮২২ খৃষ্টাব্দে, সার্ভেয়র এনসাইন প্রিন্সেপ (Ensign Prinsep), তৎকালীন সুন্দরবন কমিশনার মিঃ ডেলের (Mr. Dale) নির্দেশে সুন্দরবনের পুনর্সবেক্ষণ শুরু করেন। ১৮২২ খৃষ্টাব্দের মধ্যেই তিনি পূর্বে যমুনা নদীর তীরে প্রাণপুর (বর্তমান বাংলাদেশের অংশ) থেকে পূর্বে পিয়ালী নদীর তীর পর্যন্ত সর্বেক্ষণ সেরে ফেলেন। ১৮২৩ খৃষ্টাব্দে, তিনি পিয়ালী নদী থেকে অধুনা কুলপির খানিক দক্ষিণে, হুগলি নদী পর্যন্ত বাকি অংশের সর্বেক্ষণ সম্পূর্ণ করেন। যমুনা থেকে হুগলি পর্যন্ত, প্রায় ১৮০ মাইল নদীপথ তিনি অতিক্রম করেছিলেন, কেবল এই সর্বেক্ষণের জন্য। এই সর্বেক্ষণটি বহুলাংশে পূর্ববর্তী উল্লিখিত, মরিসন ভ্রাতৃদ্বয়ের দ্বারা নির্মিত মানচিত্রের ভিত্তিতে হলেও, তার করা সার্ভে এযাবৎ কালের মধ্যে সবচাইতে সঠিক ছিল। এই ১৮০ মাইলের যে নদী ও অরণ্যপথ তিনি পার করেছিলেন, তাকে ভিত্তি করেই, ব্রিটিশ সরকার একটি কাল্পনিক রেখা এঁকেছিল, যার নাম প্রিন্সেপের রেখা বা Prinsep’s Line। এই রেখাটা মোটামুটিভাবে, উত্তরে ‘পতিতাবাদী মহল্লা’ অর্থাৎ ‘সেটেলমেন্ট’ বা জনবসতি ও কৃষিজমি, এবং দক্ষিণে বনভূমির সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিল।
(৩) এরপর উইলিয়াম ড্যাম্পিয়ার (William Dampier) সুন্দরবনের নতুন কমিশনার নিযুক্ত হন। তার অধীনে নতুন সার্ভেয়ার নিযুক্ত হন লেফটেন্যান্ট অ্যালেক্স্যান্ডার হজেস (Lt. Alexander Hodges)। ইতিমধ্যেই, সুন্দরবন কমিশনের সীমানা তৎকালীন, ২৪ পরগণা জেলা অতিক্রম করে, তৎকালীন খুলনা ও বাকেরগঞ্জ জেলাকেও (দুই জেলাই বর্তমান বাংলাদেশের অংশ) অধিগ্রহণ করেছিল। ১৮২৮ থেকে ১৮৩১ সালের মধ্যে, পূর্বতন প্রিন্সেপ রেখাকে ড্যাম্পিয়ার-হজেস রেখা বা Dampier-Hodges Line হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৮২৯ ও ১৮৩০ খৃষ্টাব্দে, এই দুই আধিকারিকের নেতৃত্বে যমুনা নদী থেকে পূর্ববর্তী খানিকটা অংশ সর্বেক্ষণ করা হয়‌। তবে এর পরে পূর্ববর্তী সুন্দরবনে এরকম সর্বেক্ষণ হয়েছে বহু পরে। ড্যাম্পিয়ার ও হজেস, সমগ্র সুন্দরবনকে দুইশতাধিক ‘লট’ (Lot)-এ বিভক্ত করে দেন। লোকমুখে ‘লট’ শব্দটি কোথাও কোথাও ‘লাট’ উচ্চারিত হয়। জনবিরল সুন্দরবনে নামের অভাব থাকার দরুন, এই লটগুলোকে ১ থেকে ২৩৬ পর্যন্ত সংখ্যা আরোপ করা হয়। আজও সুন্দরবনের বেশ কিছু জনবসতি, এই লট ও তার উপর আরোপিত সংখ্যা দিয়েই পরিচিত। যেমন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার বাসন্তী ব্লকের জনপ্রিয় পর্যটন স্থল ঝড়খালির নিকটস্থ ‘লট নং ১২৬’।
(৪) এর পরেও ১৮৪১ থেকে ১৮৫২ খৃষ্টাব্দের মধ্যবর্তী ক্যাপ্টেন স্মিথ (Captain Smyth) ও মুলিন (Mullin) এর নেতৃত্বে আরো বেশ কয়েকটা সর্বেক্ষণ হয়, তাতে অবশ্য ওই Dampier-Hodges Line এর কৌলিন্যে বিশেষ ফেরবদল হয়নি।

ড্যাম্পিয়ার-হজেস রেখার গুরুত্বঃ-
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই রেখার গুরুত্ব অপরিসীম। এই রেখাকে ভিত্তি করেই, পূর্বতন সুন্দরবন ও ক্ষয়প্রাপ্ত আজকের সুন্দরবনের মধ্যে পর্যালোচনা করা হয়‌। বর্তমানে ভারতীয় ভূখন্ডে এই রেখাটির সর্বাধিক গুরুত্ব, সুন্দরবন জীব পরিমন্ডল, অর্থাৎ Sunderbans Biosphere Reserve এর উত্তর সীমান্ত নির্ধারণকারী রেখা হিসেবে। বর্তমানে, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ক্যানিং ১ ও ২, গোসাবা, বাসন্তী, জয়নগর ১ ও ২, কুলতলী, মথুরাপুর ১ ও ২, পাথরপ্রতিমা, কাকদ্বীপ, নামখানা ও সাগর ব্লকগুলো, ও তার সাথে জয়নগর-মজিলপুর পৌরসভা অঞ্চলগুলো এই জীব পরিমন্ডলের অন্তর্ভুক্ত। একই সাথে, উত্তর ২৪ পরগণা জেলার, হাড়োয়া, মিনাখাঁ, হাসনাবাদ, সন্দেশখালী ১ ও ২ এবং হিঙ্গলগঞ্জ ব্লক ও টাকি পৌরসভা অঞ্চলগুলোও এই জীব পরিমন্ডলের অন্তর্ভুক্ত। এই রেখাকে ভিত্তি করেই, বর্তমানে বনদফতর নির্ধারণ করে গত ২০০ বছরে সুন্দরবন কতটা ক্ষৎপ্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

পরিশেষে এইটাই বলা যায়, যে সেদিন নিছক, রাজস্ব আদায় ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কোষাগার ভরবার অভিপ্রায় নিয়ে যেই কাল্পনিক রেখা অঙ্কিত হয়েছিল, সেই রেখাই আজ, তাদের শুরু করা পাপের শৃঙ্খলা, অর্থাৎ অর্থলোভে সুন্দরবনকে ধ্বংসের প্রক্রিয়ার দীর্ঘমেয়াদী ও সুদূরপ্রসারী প্রভাবের মানদন্ড হিসেবে ধার্য হয়েছে। অতএব, যাঁরা সুন্দরবনকে ভালোবাসেন, অথবা সুন্দরবনকে বাঁচানোর চেষ্টায় রত আছেন, তাঁদের জন্য ড্যাম্পিয়ার-হজেস রেখা বা প্রকারান্তরে, প্রিন্সেপের রেখার গুরুত্ব কিন্তু অপরিসীম। এই রেখাকে সম্মান দেওয়া এবং এর সম্পর্কে বিশদে গবেষণা করা, আমাদের সকলের কর্তব্য। ইংরেজ জাহাজ ইন্সপেক্টর হেনরি পিডিংটন, পোর্ট ক্যানিং স্থাপনের সময়কালে, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারকে বলেছিলেন, সুন্দরবন হল বঙ্গোপসাগরে উত্থিত ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে বাংলার সবচাইতে বড় ও বিশ্বস্ত বর্ম, ও তার ক্ষতিসাধন, আখেরে বাংলাকে ভোগাবে। এর বাস্তব উদাহরণ সাম্প্রতিক কালে আমরা দেখেছি। তাই সুন্দরবন এবং এই রেখার গুরুত্ব বুঝে নেবার সময় কিন্তু এসে গেছে।

লেখকঃ- পাভেল ঘোষ (দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান)
সম্পাদক, দুর্গাপুর ওয়াইল্ডলাইফ ইনফরমেশন অ্যান্ড নেচার গাইড সোসাইটি (WINGS) এবং অতিথি অধ্যাপক, কনজারভেশন বায়োলজি বিভাগ (স্নাতকোত্তর), দুর্গাপুর গভর্নমেন্ট কলেজ
তথ্যসূত্রঃ- (১) সুন্দরবন জীব-পরিমন্ডল — সুধীন সেনগুপ্ত ; (২) THE SUNDARBANS FISHERS Coping in an Overly Stressed Mangrove Estuary — Santanu Chacraverti — Samudra Monograph Publication (৩) Indian Sundarbans Delta – A Vision (World Wildlife Fund, 2011) (৪) Frederick Eden Pargiter: A Revenue History of the Sundarbans from 1765 to 1870) (৫) লেখক কর্তৃক সুন্দরবন সফর এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের থেকে সংগৃহীত তথ্যাদি
প্রথম প্রকাশঃ ভূগোলিকা ফেসবুক পেজ, তৃতীয় বর্ষপূর্তি-৩০/০৩/২০২০

©ভূগোলিকা-Bhugolika
©মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

পাভেল ঘোষ

সম্পাদক, দুর্গাপুর ওয়াইল্ডলাইফ ইনফরমেশন অ্যান্ড নেচার গাইড সোসাইটি (WINGS) এবং অতিথি অধ্যাপক, কনজারভেশন বায়োলজি বিভাগ (স্নাতকোত্তর), দুর্গাপুর গভর্নমেন্ট কলেজ

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত