প্রসঙ্গঃ অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যপাঠ আবশ্যিক করা

প্রসঙ্গঃ অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যপাঠ আবশ্যিক করা

সনৎকুমার পুরকাইত

লেখকঃ সনৎকুমার পুরকাইত
সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, রায়দিঘি কলেজ


(এক)

রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে যদি একজন সুনাগরিক হিসাবে ভাবতে বসি, তাহলে একটা কথা মনে আসা উচিত, ভাষা যদি মনের ভাবপ্রকাশ করবার একমাত্র ও অনন্য মাধ্যম হয়ে থাকে, তাহলে পৃথিবীর যে কোন ভাষা জানাটাকেই জাতির অতিরিক্ত জ্ঞান হিসাবে ধরা হবে। আর যদি সেই ভাষা তাঁর দেশের আভ্যন্তরীণ ভাষা হয়ে থাকে তো আর কথা নেই। সেইসুত্রে আমার মনে হয়, মাতৃভাষাকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে হিন্দি ও ইংরাজি শেখা বাধ্যতামূলক করা আশু জরুরী। আর যদি রাজনীতির ঠেলাঠেলিতে যাই, তাহলে দেখা যাবে গেরুয়াবাহিনী বা তাঁদের অনুগামী মনে করছে হিন্দি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে মনে হয় কেন্দ্রীয় সরকারের জয় হয় আর সেটা যদি আটকানো যায় কোনভাবে তাহলে রাজ্যসরকারের অনুগামী মনে করে এটা আমাদের নৈতিক জয়। জানি না এঁদের মাথার নেতৃত্ব কি ভাবছেন? তবে বিষয়টা যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত নহে, তা আমার মনে হয়েছে। যদি তাই বা হয়ে থাকে তাতেও ক্ষতি কোথায়? আরে বাবা একটা ভাষা শেখা হবে তো, এমনটা তো নয়, যে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের উপর রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত হিন্দি ভাষা ও সাহিত্য পাঠ আবশ্যিক করা আর যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হিসাবে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়া আলাদা বিষয়। বিরোধিতা করব বলেই করলে হবে না, যুক্তি দিয়ে তার বিরুদ্ধে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে।

ভারতের ভাষা মানচিত্র
ভারতের ভাষা মানচিত্র

(দুই)

এবার আসি কেন আমরা এত আহ্লাদিত। আমরা যারা শিক্ষার ধারক বাহক বলে মনে করি, তারা খুব ভালো করেই জানি, যে কোন ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রথমেই বলে রাখা ভালো, এখানে যা কিছু বলবো তা আমার ব্যক্তিগত জীবনচর্চা ও অভিজ্ঞতার ফসল। ভালো না লাগলে এড়িয়ে যাবেন অনুগ্রহপূর্বক। সেটা ছিল ১৯৯২ সাল, আমি তখন প্রাথমিকের গণ্ডী পেরিয়ে মাধ্যমিক স্কুলের পঞ্চম শ্রেনির অজ পাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা গোবেচারা এক ছাত্র। আমাদের যতগুলো বিষয় পড়তে হবে তার সাথে দেখি বুকলিস্টে একটা হিন্দি বই আর তার সহায়িকা লেখা। এটাও আমাদের পড়তে হবে। তখন সোশ্যাল সাইট বলতে কিছুই ছিল না। এ নিয়ে কারুর মাথাব্যাথাও ছিল না। যে চতুর্থ শ্রেণী পাশ করে একটা কিশোর কিভাবে হিন্দির মতো একটি অপরিচিত ভাষা পড়বে বা শিখবে! আমরা পড়েছিলাম পড়তে হবে সেই কারণে, শিখেছিলাম শিখতে হবে সেই তাগিদে। তখন কি এর প্রয়োজনীয়তা আমরা কিছুই বুঝি ছাই। মজার বিষয়, এই বিষয় যারা পড়াতেন তখন, তাঁরা কেউ হিন্দি ভাষা নিয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত না। কিন্তু এত সাবলীলভাবে বাচ্চাদের শিক্ষা দিতেন মনে হত যেন বাংলার ক্লাস চলছে।

(তিন)

যাইহোক, অনেকের মতে, এই হিন্দি শিক্ষা সরকারের একটা চাল, সরকারী টাকায় হিন্দি ভাষাকে প্রোমোট করে হিন্দি ভাষাকে প্রতিস্থাপন করে অন্য ভাষার মর্যাদা কেড়ে নেবার পরিকল্পনা। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয়, এই হিন্দি ভাষা কোন সরকারের নিজস্ব ভাষা নয়। তারপর স্বাধীনতার পর থেকে এই দেশে কোন একটি সরকার চিরকাল ক্ষমতায় ছিল না। আমি যদিওবা ধরে নিই যে, যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবন। সেখানেও আমার একটা যুক্তি, যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ভারতের মসনদে যেই সরকারে আসুক সারা ভারতের প্রত্যেকটা প্রান্ত থেকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সাংসদ বর্তমান থাকে। তাহলে তাঁদের ভাষার অপমান হচ্ছে জেনেও তাঁরা চুপ ছিলেন। আপনি হয়তো বলবেন যে, এতদিন এটা আবশ্যিক করা হয় নি তাই কেউ কিছু বলার প্রয়োজন মনে করেন নি। তাই যদি বলেন সেটা আরও ভুল হবে। কারণ, আজকে কাগজে কলমে ঘোষণা করেছে শেখানোর জন্য আর এতদিন রাষ্ট্রের কার্যকরী ভাষা হিসাবে হিন্দি যে এক এবং অন্যতম ভাষা হিসাবে জায়গা পেয়ে এল, বর্তমানে পাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে পাবে। সেটা কি কম অপমান মনে করেন? অবশ্য, আপনাদের কাজ আংশিকভাবে চালিয়ে নিয়েছেন হিন্দির সাথে ইংরেজি ছিল বলে। খুব ভালো করে মনে পড়ে, আমরা যখন ইউপিএসসি, রেল বা এস এস সি’র পরীক্ষা দিতাম সেখানে হিন্দি আর ইংরাজিতে প্রশ্ন হতো, আজও হয়। আমরা প্রাথমিক পরীক্ষায় পাশ করলেও মেন পরীক্ষায় গিয়ে আটকে গেছি। কারণ হিন্দি যাঁদের মাতৃভাষা তাঁরা ইংরাজিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিব্বি মাতৃভাষায় দুগ্ধপান করে বলশালী হয়ে চাকরি জুটিয়ে ফেলে। আমরা সব জেনেও প্রকাশ করার ভাষা না পেয়ে ব্যর্থ মনোরথে প্রত্যাবর্তন করতে হয়। আজও, বাংলার ছেলেদের এই সব পরীক্ষায় সাফল্য পেতে দিল্লীতে চাণক্য বা এইরকম কিছু একটাতে কোচিং নিতে হয়। কারণ, হিন্দি জানা নেই।

(চার)

অনেকের মতে, হিন্দি কেন ইংরেজি আবশ্যিক করা হোক। ভারতবর্ষের এই আঞ্চলিক দ্বন্দ্বের কারণে নিজেদের উন্নয়ন ঘটে নি। ইংরেজি সাহেবি ভাষা, আন্তর্জাতিক ভাষা। সেই ভাষা রপ্ত করবো তবু পাশের রাজ্যের ভাষাকে রপ্ত করবো না। কারণ, তা করলে আমার কি সুবিধা সেটা পরে জানবো, কিন্তু ওঁর সম্মান ও মহিমা দুই বেড়ে যাবে। সেটা হতে দেওয়া যাবে না। আরে ভাই, তা করতে গেলে তো রাষ্ট্রের কাজকর্মের ভাষা পরিবর্তন করাটা আশু প্রয়োজন। তা কি পারবেন? পারবেন না, কারণ আমাদের সকল রাজকীয় অফিস হিন্দি বলয়ে অবস্থিত। ভারতীয় সংসদে আপনি পারবেন বাংলার জন্য বাংলা ভাষায় লড়াই করে কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে। আপনি যখন বাংলায় কথা বলা শুরু করবেন, আপনাকে বলা হবে যে, পরে লিখে জমা দিতে। এটা শুধু বাংলা নহে, হিন্দি আর ইংরেজি বাদে প্রায় সব ভাষার ক্ষেত্রে একই চিত্র। সেখানে তো আপনি বলতে পারবেন না যে, একচোখে বিচার করা হচ্ছে। আপনি তো আর বলতে পারবেন না, দিল্লীতে রাজদরবার না করে কন্যাকুমারী, গৌহাটি, কাশ্মীর কিংবা আহমেদাবাদে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক। এতে হিন্দি বলয়ের মতো অন্য বলয়গুলো বঞ্চনা থেকে মুক্তি পায়। তা হবে না, হতে পারে না। এটা অবশ্যই ঠিক কথা, ভারতের রাজধানী যদি চিরকাল কলকাতায় থেকে যেত তাহলে ইংরাজির পাশাপাশি বাংলা অনেক বেশী গুরুত্ব পেত, হিন্দি নহে। সারা ভারতের প্রতিনিধি বাংলা শিখে নিত। সরকারী প্রচেষ্টায় নহে, নিজেদের গরজে শিখতে হত তৎকালীন রাজধানীর ভাষা। তখন আমাদের মতো হিন্দিভাষী বা অন্যান্য ভাষার লোকজনের আক্ষেপ থেকে যেত।

(পাঁচ)

তবে বাঙালী আবার এতটাই বিচিত্র, এরা অন্যরাজ্যে গেলে সেই স্থানের মানুষের সাথে কাজ চালাতে নিজেদের তাগিদেই ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দি আর ইংরাজি বলে নিজেদের কাজ গুছিয়ে আসে। সেখানে জেদ ধরে বাংলা বলে না যেমন তেমনি কেউ যদি বাইরের রাজ্য থেকে এই বাংলায় আসেন তাঁর সাথে কথা বলার সময় বাঙালী উদার হয়ে হিন্দি বা ইংরাজিতে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাষায় কথা বলতে পেরে বন্ধু বা সতীর্থদের মাঝে মহিমান্বিত হতে চান যে, তিনিই পেরেছেন। কেবল তিনিই পারেন। আরে ভাই এই তো সুযোগ, আপনি বাংলা ছাড়া কিছু না বললে আপনার বাঙালী সত্ত্বা চিরস্থায়ী হতো যেমন, বাংলায় প্রবেশ করার পূর্বে ওঁরা বাংলা শিখে আসতেন নিজেদের গরজে। তা করবেন না। আপনি সারা ভারতবর্ষে অন্য ভাষার সাথে বাংলা ভাষা বা নিজের মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠা করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হচ্ছেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক স্তরে নয় কেন? সেখানে সামাল দেবার জন্য কেন ইংরেজিকে প্রোমোট করতে বলেন কিরূপে? মজার বিষয় হল, বকের দিয়ে খাওয়াব তবু ঘুনীতে মাথা দেব না এই স্টাইলের মাছের মতো আমাদের ভাষা প্রেম।

(ছয়)

যাঁদের বাংলা ভাষা বা মাতৃভাষার প্রতি এত প্রেম, তাঁরা নিজেদের সেই ভাষা সম্পর্কে কতটা সচেতন। কত শুদ্ধ বাংলা বলেন আপনি? লেখেন বা কতটা? নেহাত, হা করলে হাওড়া অনেকেই আগ বাড়িয়ে বুঝে নেন তাই বাঁচোয়া। ভাষা হল মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম যদি হয়, তাহলে সব ভাষাই তাই। দেশের সরকার কিন্তু কোন আঞ্চলিক ভাষা শিখে নিয়ে সেই ভাষায় জনগণের কাছে পৌঁছায় না, দেশের সাধারণ মানুষের সরকারের কথা, বা কাজ বুঝতে তাঁদের কার্যকরী ভাষা শিখতে হয়। আপনি যখন সরকারের কার্যকরী ভাষার পরিবর্তন করতে পারবেন না, তাহলে ঐ ভাষা আপনাকে শিখতেই হবে, নইলে আপনি পিছিয়ে পড়বেন স্বাভাবিক নিয়মে। এক্ষেত্রে আপনি বলতেই পারেন, আমার দরকার নেই সরকারের কাজ জেনে, প্রকল্প জেনে। সে বলতেই পারেন। শুধু আপনি কেন, সারা ভারতের অজ্ঞ, মূর্খ, নিরক্ষর, প্রান্তিক, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত দরিদ্র, অবহেলিত, পদদলিত, নিষ্পেষিত চিরঅপাংক্তেয়র দল বলেন। তাঁদের সাথে এখন অনেক সাংসদও বলেন। তাঁরা ভাষার প্রতিবন্ধকতায় কিছুই বলেন না, শোনেন না। শুধু ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে কোটি কোটি মানুষের প্রতিনিধি হয়ে ভারতীয় সংসদে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারেন নির্দ্বিধায়। এটাই হল বর্তমান ভারত। যে দেশে সাংসদ বিধায়ক হতে গেলে কোন শিক্ষাগত যোগ্যতার দরকার নেই, সেই দেশের সংসদ ভবন নিশ্চিন্তে ঘুমাবার জন্যে তো।

(সাত)

আবার এটাও শুনলাম, যে হিন্দি ভাষার প্রসার আবশ্যিক করে গোঁড়া হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার একটা পদক্ষেপ শুরু হল। আরে ভাই এই ভাজপা সরকার বা সঙ্ঘ বাহিনী না হয় হিন্দুত্ববাদকে সাথী করেছে বা তাঁদের হাত ধরে হিন্দি ভাষা শিক্ষার আবশ্যিক হবার ঘোষণা হয়েছে বলে এমন মনে হয়েছে। কিন্তু এত বছর ধরে জাতীয় কংগ্রেসের হাতে সরকার ছিল তাঁরা এই হিন্দিকে প্রশ্রয় দিয়ে কি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন? এটা একেবারে রাজনৈতিক অনীহা থেকে যে বলে ফেলেছেন তা বোঝাই যাচ্ছে। কারণ, কোন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কোন নির্দিষ্ট ভাষাকে অবলম্বন করতে হয় নি। আর যদি তা প্রয়োজন হয় সেটা প্রচারকদের শিখতে হয়েছে, যাঁদের কাছে প্রচার করবে তাঁদেরকে সেই ভাষা চাপিয়ে দিয়ে হয় না। কারণ, নতুন একটি ভাষার চাপ পড়লে ঐ নতুন ধর্ম সম্পর্কে অনীহা, অসন্তোষ বা অরুচি আসতে পারে। প্রচার বা প্রসার কোনটাই হয় না। তাই যদি হত, মহাপ্রভুর প্রেমধর্ম সারা পৃথিবীতে পৌঁছে যেত না। রাশিয়া, ইংল্যান্ড, আমেরিকাতে রাস্তায় রাস্তায় কৃষ্ণনাম শোনা যেত না। বরং বাইরের দেশ থেকে এসে অনেকেই মায়াপুরে এসে পড়ে আছেন। প্রেমের বাণী আস্বাদন করিবার লাগি বাংলা ভাষা শিখছেন, পরে সেই শাস্ত্র অনুবাদ করে নিজের কমিউনিটিতে পৌঁছে দিচ্ছেন। এভাবেই হয় মতাদর্শের প্রসার। আপনি বলতে পারেন না যে, উর্দু বা আরবি না জানলে ইসলাম ধর্ম প্রচার হবে না বা ইংরেজি বা ইহুদী না জানলে খৃষ্টান ধর্মের প্রসার ঘটে না। এটা শুধুমাত্র বিরোধিতা করার জন্য করা হয়। মনে রাখবেন কোন সরকার সব ঠিক করেন না যেমন, তেমন সব ভুলও করেন না। ভালোকে ভালো বলতেই হয়। গঠনমূলক সমালোচনার মধ্যে দিয়ে কাজের গুণ ও মাণ দুটিই বাড়ে।

(আট)

কেউ কেউ বলেন চাপিয়ে দেবার কিছুই নেই। হিন্দি শেখার অনেক উপায় আছে। হিন্দি কেন সব ভাষার শেখার অনেক উপায় ছিল, আছে চিরকাল থাকবে। কিন্তু শিখছে না কেন? কারণ, শেখাটা আবশ্যিক নহে। হিন্দি বলয়ে গিয়ে নানান অঙ্গভঙ্গি করবো কিংবা সমগ্র গ্রুপের মাঝে নিজেকে গুটিয়ে রাখবো, তবু শেখার দরকার নেই। আমাদের ছোটবেলা থেকে একেবারে ১৫ ক্লাস পর্যন্ত ইংরাজি ভাষা আবশ্যিক, সেখানে কেন শিখছেন আপনারা? আপনাদের মধ্যে কতজন ভারতের বাইরের দেশে যাবেন? এর উত্তর নেই, কারণ আপনি শিখছেন আপনার দরকারে, লড়াইয়ে টিকে থাকতে। অস্তিত্ত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই গো। আপনি যখন মনে প্রাণে মেনে নিয়েছেন হিন্দি আমাদের রাষ্ট্রের কার্যকরী ভাষা, সেখানে শেখানো মানতে পারছেন না কেন? কোলকাতার গোলপার্কে রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিটিউট অব কালচারে বিভিন্ন ভাষা শেখানো হয় বলে ভাববেন না, সুন্দরবনের প্রান্তিক মানুষ, সাঁওতাল পরগণার মানুষ, কোচবিহারের কোচ সম্প্রদায় এখানে এসে হিন্দি শিখে যাবেন। সরকারী উদ্যোগ ও আবশ্যিকতা থাকলে বই বা পরিকাঠামো দেশের কোণে কোণে পৌঁছে যাবে নিয়ম করে।
এবার আসি, আমরা যারা হিন্দি প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে চিৎকার করলাম, তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি হিন্দি কিন্তু প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে অনেক আগেই। আমরা মৌনব্রত অবলম্বন করে দশকের পর দশক তা মেনে নিয়েছি। এখন যেটা হতে চলেছে তা হিন্দি শিক্ষার আবশ্যিক ব্যবস্থা মাত্র। আপনি বলুন, আপনার রাজ্যে সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলেন? আপনার ৯ কোটি মানুষ মানেই ৯ কোটি বাংলা বলে তা নয় কিন্তু। আপনি চলে যান, দক্ষিণ কলকাতা বা মধ্য কলকাতা বা হাওড়া, পার্ক সার্কাস, মল্লিকপুরের একটা বিরাট জনগণ হিন্দি ছাড়া কিছুই বলেন না। সুন্দরবনের প্রান্তিক মানুষ, সীমান্তের মানুষ, সাঁওতাল পরগণার মানুষ, বা উত্তরের জেলাগুলিতে তাঁদের নিজেদের একটা একটা আঞ্চলিক ভাষা বর্তমান। সেখানে তাঁরা বাংলা শিখেছে তাঁদের দরকারে, কারণ তাঁদের ভাষায় রাজ্যের শিক্ষা হয় না, উচ্চ শিক্ষায় তাঁদের ভাষা পাওয়া যায় না। আপনাদের কথামতো বাংলার পাশাপাশি সেই ভাষাকে বঞ্চিত না করে সেই ভাষায় বিধানসভায় বক্তব্য তুলে ধরার অধিকার দেওয়া উচিৎ। কিন্তু কে দেবেন? বাংলা রাজ্যের কার্যকরী ভাষা যে।

(নয়)

আমরা যারা হিন্দি বিরোধী হলাম বাংলা প্রেমী হতে, তারাই গবেষণাপত্র জমা দিতে গিয়ে, সেমিনার বা আলোচনাসভায় বাংলা এড়িয়ে ইংরেজি বলে নিজেদেরকে কেউকেটা বলে মনে করি। সেখানে বাংলা বলতে চাই না, বরং প্রমাণ করতে চাই, আমার ঠিক বাংলাটা আসে না। এটাই চিত্র। আন্দোলন করতে হলে সেটাই করুন যে বাংলাভাষায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ উন্মোচন হোক। তা হবে না। আরে ভাই, হিন্দি তো আর সংস্কৃত বা আরবি ভাষার মতো নয় যে কোন ধর্মীয় সুড়সুড়ি রয়েছে। আগেই বলেছি আমরা পঞ্চম শ্রেনিতে হিন্দি শিখেছি আর ষষ্ঠ থেকে অষ্টম পর্যন্ত সংস্কৃত বা আরবি আবশ্যিক পাঠ গ্রহণ করেছি। খুব মজা ছিল। তাতে আমাদের মধ্যে বাংলা প্রেম উড়ে যায় নি। ইংরেজিতে ভীতি আসে নি। বরং আমাদের সময়ে নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশে দুটো করে পেপার পড়তে হতো। বর্তমানে একটা হিড়িক চলে এসেছে যে বাচ্চাদের উপর চাপ পড়ে যাচ্ছে, কমিয়ে দাও। আরে কমাতে কমাতে আর থাকবেই না, জানবেই না অনেক কিছু। শেখা তো দূরের কথা, ওগুলো যে আছে সেটাই জানবে না। ভাষা শিক্ষা বাংলা ইংরেজির মতো হিন্দি হতেই পারে। এতে এত বিরোধিতার কোন মানে দেখি না।

(দশ)

আপনি কলকাতার বুকে ন্যাটমোর অফিসে গেলে দেখতে পাবেন কোন বাংলা চলে না। কলকাতার বুকে সার্ভে অব ইন্ডিয়া’র অফিসে গিয়ে দেখুন কোন বাংলা চলে না। কলকাতায় অবস্থিত জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া বা অন্য কোন কেন্দ্রীয় অফিসে গেলেই একই চিত্র পাবেন। সেখানে কেউ গিয়ে বলতে পারেন, যে বাংলায় কথা বলুন। পারবেন না, সেখানেও আপনার উদারতায় আপনি ওঁদের ভাষা আত্মস্থ করে ফেলবেন। এটাই বাঙালী আর বাংলা ভাষা আন্দোলনের রূপ। ভাষা আন্দোলন যারা করেছিলেন তাঁদের জন্য গর্ব হয় যে, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে উচ্চ শিক্ষায় সব জায়গায় বাংলা ভাষাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। বাংলাদেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের বরিষ্ঠ অধ্যাপক কলকাতায় ঘরভর্তি লোকের সামনে বক্তব্য দিতে বাংলা ভাষাকে বেছে নিতে দেখেছি। এখানেই মাতৃভাষা আন্দোলনের সাফল্য। এখানেই বাঙালী হয়ে গর্ব।

(এগারো)

পরিশেষে, হিন্দি রাষ্ট্রভাষা না হলেও হিন্দি ভারতের সব থেকে বেশী কার্যকরী ভাষা, অন্তত সরকারী স্তরে। ভারতের অনেক ভাষা থাকতে পারে তবে হিন্দি সব থেকে বেশী রাজ্যে ব্যবহৃত হয়, প্রায় ১০ টি রাজ্য। এমনকি যেখানে অন্য ভাষার রাজ্য সেখানেও হিন্দির চল আছে ভালোভাবেই। সেটা আমাদের কলকাতা শহর জ্বলন্ত প্রমাণ। ভাষাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন হয়েছে বা হবে, কিন্তু সেটা মাতৃভাষাকে বাঁচাতে, অন্য ভাষাকে আটকাতে নহে। বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল সেটা বাংলাকে সরকারী ভাষা করার দাবীতে, উর্দু ভাষা শিক্ষার বিরুদ্ধে নহে। পাকিস্তানের তৎকালীন সরকার সেই উর্দুভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সরকারী রাষ্ট্রভাষা হিসাবে। পরিণতিতে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন বা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ সবকিছুই হয়। পাকিস্তান যদি বলত যে পুরব পাকিস্তানের সরকারী ভাষা বাংলা হবে আর উর্দু ভাষা শিক্ষা আবশ্যিক করা হল, তাহলে এমন টা হতো বলে আমার মনে হয় না। কারণ, শিশুর মুখ মায়ের বুকের দুধ সরিয়ে মাংস খেতে দিলে শিশু বিদ্রোহ করতে পারে, কিন্তু তাঁর মায়ের বুকের দুধ রেখে অন্য কিছু খাবার দিতে থাকুন। ধীরে ধীরে সে অভ্যস্ত হবে। আজ থেকে ২৭ বছর আগে আমি হিন্দি ভাষা পাঠ নিয়েছিলাম বিদ্যালয়ে তাতে ভারত সরকার আঞ্চলিক ভাষা সরিয়ে হিন্দিকে সরকারী ভাষা করতে পারে নি আজও, ভবিষ্যতেও পারবেন না। কোন সরকার চিরস্থায়ী নয়। এই বোকামি কোন সরকার করতে পারেন না। ভারতবর্ষ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সরকার, সংবিধান আছে, সংবিধান স্বীকৃত ভাষা আছে – তা অস্বীকার করা যায় না।

লেখকঃ সনৎকুমার পুরকাইত, সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, রায়দিঘি কলেজ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)।

©Mission Geography India

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত