‘ঘুঁটেকুড়ুনির ছানা’র ‘পাথরচাপা কপাল’ : একটি ভৌগোলিক নিবন্ধ

‘ঘুঁটেকুড়ুনির ছানা’র ‘পাথরচাপা কপাল’ : একটি ভৌগোলিক নিবন্ধ

নিবন্ধের শিরোণামে ব্যবহৃত দুই শব্দযুগলের মালিক বর্তমান প্রবন্ধকার নন, এই কথা বলেছিলেন প্রখ্যাত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। দেশ ও কালের পরিসরে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজনীতির রক্তচক্ষুর সামনে চিরকাল কিছু মানুষ অবহেলিত, পদদলিত, নিষ্পেষিত, অপাংক্তেয় হয়ে এসেছে। সেই পিছিয়ে পড়া বঞ্চিত সমাজের মানুষের দলের করুণ দুর্দশা দেখে কবিমনে জায়গা পেয়েছিল উপরের প্রথম শব্দযুগল ‘ঘুঁটেকুড়ুনির ছানা’ আর তাঁদের নিয়ে যে নোংরা ভূ-রাজনীতি করা হয়েছিল, তা দেখে তিনি পরের শব্দযুগল ‘পাথরচাপা কপাল’ ব্যবহার করে তৎকালীন পরিস্থিতির সুন্দর ব্যাখ্যা করে দেন। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপে সাতের দশকের শেষদিকে শরণার্থী মানুষের ঘাঁটি গেড়ে বসা নিয়ে যে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা কালের ক্রমবিবর্তনে মানুষ ভুলে গেলেও, ইতিহাস ভোলেনি। বাংলার ভূ-রাজনীতিতে কলঙ্কিত অধ্যায়গুলির মধ্যে এটা ছিল অন্যতম নৃশংস।

প্রথমেই বলে রাখি, নিবন্ধের শুরুতে একটু রাজনৈতিক চর্চা থাকলেও, তা আমাদের বিষয়ের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। ভূ-রাজনীতির কারনে জনসংখ্যা, জনবসতি ও পরিবেশের অবক্ষয় নিয়ে একটি ভৌগোলিক পর্যালোচনা মাত্র। সময়টা আশির দশকের শেষদিকে। বঙ্গ রাজনীতিতে পালাবদলের হাত ধরে সবেমাত্র নতুন সরকার ক্ষমতায় আসীন। বাংলার মানুষের দীর্ঘদিনের অত্যাচার, অনাচার ও অবিচারের প্রতি যে ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা জমে ছিল তার অবসান হয়ে নতুন সূর্যের মুখ দেখল। পূর্বপ্রতিশ্রুতি মতো দলে দলে উদ্বাস্তু আর শরণার্থী মানুষেরা আসতে শুরু করলো বাংলার দক্ষিনে অবস্থিত সুন্দরবনের গহন জঙ্গলে পরিপূর্ণ দ্বীপ মরিচঝাঁপি-তে আস্তানা গড়বে বলে। এখানে সে বিষয়ে বেশি চর্চা করার কোনো পরিসর নেই। তবে সেই ঘৃণ্য ইতিহাসের হাত ধরে, আমাদের মানতেই হবে যে জনসংখ্যা ভূগোলে উদ্বাস্তু সমস্যা বা শরণার্থী সমস্যা একটি অন্যতম উপাদান হিসাবে গণ্য করা উচিত। বসতি ভূগোল বা জনসংখ্যা ভূগোলের সাথে মানুষের আচার, কৃষ্টি, ধর্ম, ভাষা, জাতি, বর্ণ বা আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা জাতীয় সিদ্ধান্ত ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিবেশী দেশের সাথে সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করে।

Marich Jhapi Massacre

এখন প্রশ্ন একটাই, কি এই মরিচঝাঁপি কান্ড? পাঠকের কাছে এর উত্তর সহজভাবে দেওয়ার কোনো জায়গা নেই। কারন, সেদিনের সেই ঘটনা আদৌ সহজ ছিল না। আজকের প্রজন্ম জানেই না, আগামী প্রজন্ম এর খোঁজ নেবে না। জানার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি, ইতিহাসকে গলা টিপে খুন করতে অনেক ক্ষেত্রেই তথ্যপ্রমাণ লোপাট করে দেওয়া হয়েছে। তবে এই সংক্রান্ত কিছু লেখা প্রবন্ধ, পুস্তক বা রিপোর্ট আজও খুঁজলে পাওয়া যায়। সুন্দরবনের ঝড়খালি, কুমীরমারিতে গেলে আজও কিছু মানুষের খোঁজ মেলে যারা সেদিনের সেই ঘটনার সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছেন। তাঁদের মুখে শোনা যায় সেই দুর্দশার কথা। আজকের এই প্রবন্ধের উপস্থাপনা সেই ক্ষেত্রসমীক্ষায় উঠে আসা মানুষের মুখনিঃসৃত সেই ইতিহাসের অব্যক্ত বেদনা। তবে এখানে ছোট করে জানানো দরকার। বাংলাদেশ থেকে দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে চলে আসা শরণার্থীর দল ওড়িশার ভিতরকণিকা, মধ্যপ্রদেশের (অধুনা ছত্তিশগড়) দন্ডকারণ্য ইত্যাদি দুর্গম স্থানে আশ্রয় নিয়ে থাকতে শুরু করে। বাঙালী উৎখাত হয়ে যদি শরণার্থী হয়ে আসে তাঁরা বাংলায় স্থান পাওয়ার বিষয়ে অগ্রণী দাবিদার বলে তৎকালীন বিরোধী দল প্রচার করে এবং এদেরকে সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসে ক্ষমতায়। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তাঁদের পুনর্বাসন নিয়ে সরকার থাকে উদাসীন। তারপর নানন ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে কিছু নেতৃত্বের হাত ধরে তাঁরা এগিয়ে আসে এবং শহরের বিভিন্ন রেলকলোনি দখল করে থাকতে শুরু করে। কিন্তু এত মানুষের সহাবস্থান করতে সুন্দরবনের বাঘের আবাসভূমি তথা মরিচঝাঁপির জঙ্গলকে বেছে দেওয়া হয় বিনা সরকারি সহায়তায়। তাতেই তাঁরা নিজেদের উদ্যোগে জঙ্গল পরিষ্কার করে, দুমাসের মধ্যে মরিচঝাঁপির জঙ্গল হয়ে উঠল উদ্বাস্তু কলোনি নেতাজীনগর। সেটাই সরকার মেনে নিতে পারেনি। সরকার হয়তো ভবিষ্যতের ভূত দেখতে পেয়েছিল। ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে তাঁরা মরিচঝাঁপির জঙ্গলে আসে। কয়েকমাসের মধ্যে তাঁদের উত্থান দেখে সরকার পুলিশ দিয়ে বারবার সুন্দরবন ছেড়ে চলে যেতে বলে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ না হওয়ায় ১৯৭৯ সালের ২৪ শে জানুয়ারি পানীয়জল, খাদ্য, ওষুধসহ সংবাদমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হল। মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম রসদ আটকেও যখন সরানো গেলনা, তখন শুরু হল অকথ্য অত্যাচার আর নির্বিচারে প্রাণসংহার। ১৯৭৯ সালের ১৪ ই মে পুলিশ বাহিনী মরিচঝাঁপিতে অপারেশন শুরু করে, তিন দিনের মধ্যে অর্থাৎ ১৭ ই মে মরিচঝাঁপি ফাঁকা হয়ে যায়। এমনিতেই খাদ্য আর পানীয়জল না পেয়ে অনেকেই এই লোনা মাটির দেশে অনেক আগেই জীর্ণ, শীর্ণ হয়ে ছিল। অনেকে জঙ্গলের ঘাস খেয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিল। মরিচঝাঁপির সেই দগদগে ঘা আজও শুকায়নি। এই ইতিহাস চাপা দেওয়া এত সহজ হয়েছিল তার কারন সাতের দশকে মানুষের কাছে মিডিয়া বা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক পৌঁছায়নি। আর সদ্য ক্ষমতাচ্যূত বিরোধী দল এলিট সমাজ ছাড়া কারুর কথা ভাবেনি বলেই চিরদিনের অভিযোগ। তাই স্বদেশীয়দের মধ্যে কোনো আন্দোলন দানা বাঁধেনি। উদ্বাস্তু শরণার্থীর দল কোথাও একটু মাথাগোঁজার ঠাঁই পাচ্ছিল না, আন্দোলন তো দূরের কথা।

Marich Jhapi Massacre

আবেগী মনের দরদী কোণ থেকে হয়তো সত্য এই ঘটনা বেদনাদায়ক। কিন্তু আমরা যারা বিজ্ঞানের ছাত্র, যারা পরিবেশের কাছে দায়বদ্ধ, সেই দর্শন থেকে আমার মনে হয়েছে যে এটা দরকার ছিল। ঘটনা নিন্দনীয়, তার কারন সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা অন্যায়ভাবে ভঙ্গ করেছে। অপারেশন মরিচঝাঁপি ঘটার পূর্বে তাঁদের আরও একটু গভীরভাবে ভাবা উচিত ছিল। সুন্দরবনের জঙ্গল পরিষ্কার করে জনবসতি গড়ে তোলার সুযোগ দেওয়া আন্তর্জাতিক অপরাধের তালিকায় পড়ে। গত শতকের শুরুতেই সুন্দরবনের গোসাবা দ্বীপে হ্যামিলটন সাহেবের নেতৃত্বে যে আবাদ ও বসতি গড়ে তোলার জন্য জঙ্গল হাসিল করা হয় তা সভ্য জগতের বাসিন্দার সুন্দরবন অধিগ্রহণের নিদর্শন বলে মনে করা হয়। তবে সরকার হয়তো পরে এই পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পেরেছিলেন তাই এই ভাবে উৎখাত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারন সেদিন যদি মরিচঝাঁপি থেকে শরণার্থীর দলকে না সরানো হত, কে বলতে পারে এই পাঁচ দশকে সুন্দরবনের আরও অনেক দ্বীপ দখলে চলে যেত প্রতিবেশী দেশ থেকে আগত অবৈধ শরণার্থীর দলে। গবেষণায় প্রকাশ সুন্দরবনের এই হ্রাস আটকাতে ১৮৩১ সালে ব্রিটিশরা ড্যাম্পিয়ার হজেস লাইন টেনে সীমা নির্ধারণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটা বিঘ্নিত হয়েছে তাঁদের হাতেই। তারপর স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দেশভাগের কারনে যে শরণার্থী জোয়ার আসে তা সামলাতে সুন্দরবনের অনেক অংশই আজ সভ্যতার করাল গ্রাসে। আর বর্তমানে মানুষের অতিরিক্ত লোভ আর সঠিক পরিকল্পনার অভাবে সুন্দরবন ক্রমশ দখল হয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক অতীতকালে আমরা দেখেছি মায়ানমার থেকে আগত উদ্বাস্তু রোহিঙ্গার দল কিভাবে ভারতবর্ষে অন্যায়ভাবে প্রবেশ করছে এবং বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ বর্ডার এলাকা বেশি হওয়ার কারনে এখানে এসে বিভিন্ন স্থানে আস্তানা গাড়ছে। কর্তৃপক্ষ এখানে উদাসীন থাকছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করে সেই সহায়সম্বলহীন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সহানুভূতি দেখিয়েছে। সেটা আপাত দৃষ্টিতে মানবিক মনে হলেও দেশ ও জাতির পক্ষে এক অন্ধকার ভবিতব্যের বীজ বপন করা এবং লালন করা। তাই আন্তর্জাতিক স্বার্থে শরণার্থী পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে আবেগ বা ভোট-রাজনীতির থেকে জাতি ও জাতীয় স্বার্থের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে আগামীতে দেশের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়। নইলে একদিন হয়তো নিজভূমে পরবাসী হতে হবে আমাদের। হয়তো আমাদের একদিন পাথরচাপা কপাল নিয়ে ঘুঁটেকুড়ুনির ছানা হয়ে শরণার্থীর দলের কাছে ভিক্ষা মাগতে হবে।

♦Disclaimer :-
(১) এই প্রবন্ধের মতামত সম্পূর্ণ রূপে লেখকের ব্যক্তিগত, যা ভূগোলিকা-Bhugolika পেজের মতামত ব্যক্ত করেনা।
(২) এই ভূ-রাজনীতি প্রবন্ধে শুধুমাত্র প্রয়োজন অনুসারেই রাজনৈতিক বিষয় রয়েছে, যা কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার নয়।

লেখকঃ- সনৎ কুমার পুরকাইত (সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, রায়দিঘী কলেজ, দঃ ২৪ পরগণা)।
প্রথম প্রকাশঃ ভূগোলিকা ফেসবুক পেজ, দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি-৩০/০৩/২০১৯

তথ্যসূত্রঃ- মরিচঝাঁপি : ছিন্ন দেশ, ছিন্ন ইতিহাস – মধুময় পাল ; অপ্রকাশিত মরিচঝাঁপি (সংকলন গ্রন্থ) – তুষার ভট্টাচার্য ; মরিচঝাঁপি : নৈঃশব্দের অন্তরালে – জগদীশ মন্ডল ; সুন্দরবনের ইতিহাস – কানাইলাল সরকার ; লাস্ট ট্রেন ফ্রম খুলনা – সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত ; The Hungry Tide – Amitav Ghosh

©Mission Geography India
© ভূগোলিকা-Bhugolika

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত