জঙ্গলমহলের সাম্প্রতিক শিল্পোন্নয়ন
পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলের চারটি জেলা — পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ক্রান্তীয় পর্ণমোচী অরণ্য (বিশেষত শাল) রয়েছে। তাই এরাজ্যের এই চার জেলার ওই অরণ্যাঞ্চল একত্রে ‘জঙ্গলমহল’ নামে পরিচিত এবং উপরোক্ত চার জেলাকে ‘জঙ্গলমহলের জেলা’ বলা হয়। সুদীর্ঘকাল ধরে জঙ্গল অধ্যুষিত এই চার জেলার এক বৃহত্তর অংশ ছিল অবহেলিত। সরকারি উন্নয়নের ধারা থেকে অনেকাংশে ছিল বঞ্চিত। কয়েক বছর আগে জঙ্গলমহল ছিল মাওবাদী কার্যকলাপের হটস্পট। বর্তমানে অনেকটাই বদলেছে জঙ্গলমহল। একাধিক সরকারি প্রকল্পে জঙ্গলমহলের আর্থ সামাজিক চালচিত্রও অনেকাংশে পরিবর্তিত হয়েছে।
উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন কৃষিতে অনুন্নত জঙ্গলমহলের এই চার জেলায় উন্নতির চাবিকাঠি রয়েছে শিল্প ও পর্যটন উন্নয়নের হাতে। একদিকে জঙ্গলমহলের এক বড়ো অংশ জুড়ে কৃষি-অনুন্নত, পতিত জমি রয়েছে। পরিকাঠামোগত উন্নয়ন (বিশেষত রাস্তা, বিদ্যুৎ ও জল) ঘটিয়ে সেইসব জমিতে বৃহদায়তন শিল্পস্থাপন করলে জঙ্গলমহলের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসবে। এছাড়াও কাঁসা-পিতল শিল্প, মৃৎ শিল্প, বনজ দ্রব্য ভিত্তিক শিল্প প্রভৃতি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উন্নতি ঘটালে গ্রামীণ অর্থনীতিতে জোয়ার আসবে। অন্যদিকে, পর্যটন সম্ভাবনায় ভরপুর জঙ্গলমহলে পরিচিত পর্যটনকেন্দ্রগুলির উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ এবং নতুন পর্যটনকেন্দ্রগুলিকে রাজ্য পর্যটন মানচিত্রে তুলে ধরলে অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে।
আসুন দেখা যাক, সাম্প্রতিক কালে জঙ্গলমহলে শিল্প ও পর্যটন ক্ষেত্রে জেলাভিত্তিক উন্নয়নের এক ঝলক।
(১) পুরুলিয়া জেলাঃ-
পুরুলিয়া জেলায় ৪টি Industrial Park তৈরি করা হয়েছে — কল্যাণী ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ সেন্টার (ফেজ ১, ২ এবং ৩), হরিনঘাটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক। এই জেলায় ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগের ৬৯ টি ক্লাস্টার গড়ে উঠেছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল — ১৪ টি MSME ক্লাস্টার, ২ টি হ্যান্ডলুম ক্লাস্টার, ৪ টি খাদি ক্লাস্টার প্রভৃতি। পুরুলিয়াতে ১টি আইটি পার্ক গড়ে উঠেছে। দুলমীতে একটি গ্রামীণ হাট নির্মাণ করা হয়েছে। ক্ষুদ্র শিল্পের উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই জেলায় ৩৯৩৭ কোটি টাকারও বেশি ব্যাঙ্ক ঋণ প্রদান করা হয়েছে।
পর্যটন বিভাগে এই জেলাতে জয়চন্ডী পাহাড়ে গ্রামীণ পর্যটন সহ ৪টি পর্যটন প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। পাকবিড়রা, মুরাডি ও তেলকুপি ইকো-ট্যুরিজম প্রকল্প চালু করা হয়েছে। হাতে নেওয়া হয়েছে বাঁকুড়া – পুরুলিয়া ট্যুরিজম সার্কিটের কাজ।
(২) বাঁকুড়া জেলাঃ-
বাঁকুড়া জেলায় জেলায় ৪টি Industrial Park তৈরি করা হয়েছে — বড়জোড়ায় প্লাস্টো স্টিল পার্ক (১ম, ২য়, ৩য় পর্যায়) এবং বিষ্ণুপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ সেন্টার। বড়জোড়ায় ১টি আইটি পার্ক গড়ে উঠেছে। এই জেলায় ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগের ৩০টি ক্লাস্টার গড়ে উঠেছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল — শালতোড়ায় একটি মুরলু রুফিং টাইলসের ক্লাস্টার ; বাঁকুড়া-১ এর কেঞ্জাকুড়া ও লালবাজার, ওন্দার সুকলাই এবং সিমলাপালের পুখুরিয়ায় ৪ টি পিতলের ক্লাস্টার ; বাঁকুড়া-২-এ একটি ডোকরার ক্লাস্টার ; ছাতনায় শুশুনিয়ায় একটি পাথরের কাজের ক্লাস্টার ; রাইপুরে ২ টি শালপাতার থালার ক্লাস্টার ; বাঁকুড়া-১, বিষ্ণুপুর ও সোনামুখী পৌরসভা এবং ইন্দপুরে ৪ টি হ্যান্ডলুম ক্লাস্টার প্রভৃতি। ক্ষুদ্র শিল্পের উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই জেলায় ৩৫৩০ কোটি টাকারও বেশি ব্যাঙ্ক ঋণ প্রদান করা হয়েছে।
পর্যটন বিভাগে এই জেলাতে পাত্রসায়র ও শুশুনিয়াতে ২ টি ইকো-ট্যুরিজম প্রকল্প চালু করা হয়েছে। বিহারীনাথ, জয়রামবাটী ও মুকুটমণিপুরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। হাতে নেওয়া হয়েছে বাঁকুড়া হোমস্টে ট্যুরিজম ও বাঁকুড়া – পুরুলিয়া ট্যুরিজম সার্কিটের কাজ।
(৩) ঝাড়গ্রাম জেলাঃ-
ঝাড়গ্রাম জেলায় ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগের ৩ টি ক্লাস্টার গড়ে উঠেছে। এগুলির মধ্যে ২ টি MSME ক্লাস্টার এবং ১ টি খাদি ক্লাস্টার।
পর্যটন বিভাগে এই জেলাতে ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির সংস্কার সহ একাধিক কটেজ তৈরি করা হয়েছে। ঝাড়গ্রাম ট্যুরিজম সার্কিটে লিভিং আর্ট মিউজিয়াম, ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার-কাম-ট্রেকিং রুট গড়ে তোলা হয়েছে। হাতিবাড়ি ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে। চিল্কিগড় কণকদুর্গা মন্দির সংস্কার (প্রথম পর্যায়) করা হয়েছে। রামেশ্বর মন্দির সংস্কার (প্রথম পর্যায়)করা হয়েছে। হাতে নেওয়া হয়েছে ঝাড়গ্রাম -বাঁকুড়া – পশ্চিম মেদিনীপুর ট্যুরিস্ট সার্কিটের কাজ।
(৪) পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাঃ-
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ৬টি Industrial Park তৈরি করা হয়েছে — বিদ্যাসাগর ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, সাচক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, খড়গপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, গোদাপিয়াশাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, গোয়ালতোড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, খড়গপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ সেন্টার। এই জেলায় ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগের ২৩টি ক্লাস্টার গড়ে উঠেছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল — ১৫ টি MSME ক্লাস্টার ; ২ টি হ্যান্ডলুম ক্লাস্টার ; ৬ টি খাদি ক্লাস্টার প্রভৃতি। খড়গপুরে আই.টি পার্ক গড়ে উঠেছে। শালবনীতে গড়ে উঠেছে জিন্দাল গোষ্ঠীর একটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। ক্ষুদ্র শিল্পের উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই জেলায় জেলায় ৪০০০ কোটি টাকারও বেশি ব্যাঙ্ক ঋণ প্রদান করা হয়েছে।
পর্যটন বিভাগে এই জেলাতে হাতে নেওয়া হয়েছে গনগনি নদীখাতের উন্নয়ন। এখানে ‘গণসুন্দরী’ নামের একাধিক ট্যুরিস্ট কটেজ গড়ে তোলা হচ্ছে। হিজলী ইকো-পার্কে বোটানিকাল গার্ডেন, স্পাইস গার্ডেন, অর্কিড হাউস ইত্যাদি গড়ে তোলা হয়েছে।
সাম্প্রতিক কালে জঙ্গলমহলে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে উন্নতি হলেও, এখনও পর্যন্ত কোনো বৃহদায়তন শিল্প গড়ে ওঠেনি। পরিকাঠামো ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি হলেও বৃহদায়তন শিল্পের অভাবে জঙ্গলমহলে শিল্পক্ষেত্রে সেরকম বড়োমাপের কর্মসংস্থান হয়নি। এছাড়া পর্যটন বিভাগে আরও অনেক পর্যটন কেন্দ্রগুলিকে পর্যটন মানচিত্রে তুলে ধরা বাকি রয়েছে।
লেখকঃ- অরিজিৎ সিংহ মহাপাত্র (পার্শ্বলা, বাঁকুড়া)।
তথ্যসূত্রঃ- পঃবঃ সরকার জেলা উন্নয়ন।