ভিদালের সম্ভাবনাবাদ ও বর্তমান সময়ে প্রাসঙ্গিকতা

ভিদালের সম্ভাবনাবাদ ও বর্তমান সময়ে প্রাসঙ্গিকতা

এবার আমরা আলোচনা করব সেই সম্ভাবনাবাদ তত্ত্ব নিয়ে যার জন্য ভিদাল দ্য লা ব্লাশ ফ্রান্সের ভূগোল পরিসর ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীতে আজও আলোচনায়। ভূগোলের আলোচনা যখন কিছু দেশ কালের প্রাকৃতিক ভূমিরূপ বা ঘটনার বর্ণনা ও জনমিতির আলোচনার মধ্যে সীমিত ছিল ঠিক তখন প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রনবাদের ধারনা ভূগোলে এক তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের স্বীকৃতি দিতে শুরু করে। এই সময় পৃথিবীর ভূগোল চর্চায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানের সাথে মানুষের ভিন্ন ভিন্ন অভিযোজন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। চার্লস ডারউইনের অরিজিন অব স্পেসিস এ ডারউইনবাদ এর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু পরিবেশগত পার্থক্য কোন স্থানের জনসংখ্যার পার্থক্যের সঠিক কারন হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে যখন ব্যর্থ, ঠিক তখন পল ভিদাল দ্য লা ব্লাশ এই প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ন্ত্রনবাদের ধারনাকে নস্যাৎ করে আরও দুটি উপাদানকে আলোচনায় আনেন, তা হল মানুষের সামাজিক আচরণ ও তাঁর ইচ্ছা, পছন্দ, রুচি ও ক্ষমতা। বলা ভালো প্রকৃতির সাথে মানুষের যে আন্তঃসম্পর্ক বিদ্যমান সেই ধারনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন ভিদাল। সেই ধারনায় পরিবেশকে সরিয়ে মানুষকে চালকের আসনে বসিয়েছেন ভিদাল এবং মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতি পরিবেশের নিয়ন্ত্রক- তা তিনি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালান। তাঁর ধারনা অনুযায়ী পূর্ববর্তী জার্মান প্রানিবিদ ফ্রেডরিক র‍্যাটজেলএর অ্যানথ্রপোজিওগ্রাফি গ্রন্থে প্রকাশিত প্রাকৃতিক পরিবেশের মানুষের উপর নিয়ন্ত্রন বা নিয়ন্ত্রনবাদ কোনরূপেই কঠোরভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। প্রকৃতি মানুষের কাজকর্ম বা চলাফেরাকে পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না, পরিবর্তে প্রকৃতি মানুষের সামনে বেশ কিছু সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে থাকে যার মধ্যে মানুষ তাঁর শিক্ষা, রুচি, পছন্দ বা সামর্থ্য অনুযায়ী নির্বাচন করে থাকে। তিনি যেমন চরম নিয়ন্ত্রনবাদকে পাত্তা দেন নি তেমনি চরম সম্ভাবনাবাদ তত্ত্বেও বিশ্বাস করতেন না। সময়ের সাথে সভ্যতার বিকাশ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির হাত ধরে মানুষ প্রকৃতির এই সম্পর্ক হাজার হাজার বছর ধরে পরিবর্তনশীল হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান মানুষের সংস্কৃতির কাছে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের সকল সামর্থ্য পরিবেশের খামখেয়ালিপনাতে শেষ হয়েছে। তাই তাঁর ধারনায় মানুষ পরিবেশের নিয়ন্ত্রনের থেকে এই দুই উপাদানের আত্মিক সম্পর্ক সুপ্রতিষ্ঠা পেয়েছে। পরিবেশের কাছে প্রশ্নহীন নিজেকে সঁপে দেওয়ার থেকে মানুষের মর্যাদাকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন ভিদাল। তাঁর এই কাজে সমর্থন করেন তাঁর বন্ধু ফ্রান্সের বিখ্যাত ঐতিহাসিকলুই ফেভর।তিনিও বলেন মানুষ তাঁর নিজস্ব সংস্কৃতি, অর্জিত গুণাবলী বা বংশানুক্রমে প্রাপ্ত ক্ষমতা ও বৈশিষ্ট এই অভিযোজনে দারুনভাবে সহায়তা করে থাকে।

সম্ভাবনাবাদ
Paul Vidal de La Blache (January 22, 1845 to April 5, 1918)

সম্ভাবনাবাদের পটভূমিকাঃ-

ফ্রেডরিক র‍্যাটজেল অ্যানথ্রপোজিওগ্রাফি (Anthropogeography – An introduction to the Application of Geography to History) গ্রন্থে প্রাকৃতিক পরিবেশগত নিয়ন্ত্রনবাদ এর প্রবক্তা হলেও তিনি তাঁর এই বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে মানুষের অভিযোজনের পক্ষে সওয়াল করেছেন বিশেষ করে যাযাবর উপজাতি গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে বিষয়টা অনুধাবনযোগ্য। তাঁর আমেরিকান ছাত্রী এলেন চার্চিল সেম্পেল ও বিখ্যাত আমেরিকান ভূমিরূপবিদ উইলিয়াম মরিস ডেভিসের সুযোগ্য ছাত্র এলসওয়ার্থ হান্টিংটন প্রচার করেন প্রাকৃতিক পরিবেশগত নিয়ন্ত্রনবাদ তত্ত্ব। উনবিংশ শতকের ইতিহাসে এটাই সম্ভাবনাবাদ (১৯২২) এর ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে। এলেন সেম্পেলের কথায়, ‘Man is the product of the earth’s surface. This means not merely that he is a child of the earth,- dust of her dust; but the earth has mothered him, fed him, set to task, directed his thoughts….’। এই ধরনের কঠোর চিন্তাভাবনা সরিয়ে ভিদালের চিন্তা ও দর্শনে ধীরে ধীরে প্রকৃতিকে লঘু করে মানুষকে ক্ষমতাশালী ও নীতিনির্ধারক করে তোলা হয়। তাঁর মতে প্রকৃতি কোন কর্মকাণ্ডকে তার প্রভাবে কাজের গতিকে ত্বরান্বিত বা মন্দীভূত করলেও সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না। মানুষ সেখানে থাকে আসল চালিকা শক্তি ভুমিকায়। প্রকৃতির কট্টর নিয়ন্ত্রনবাদকে সমাধি দিয়ে মানুষকে মর্যাদা প্রদান করার মধ্য দিয়ে ভিদাল তৈরি করে ফেলে এক নতুন ধারার দর্শন যা সম্ভাবনাবাদ নামে পরিচিত। সম্ভাবনাবাদের জনক ভিদাল হলেও দুঃখের বিষয় তাঁর জীবদ্দশায় এই তত্ত্ব সম্ভাবনাবাদ নামে পরিচিতি পায় নি। তাঁর মৃত্যুর চার বছর পরে ভিদালের এই মত বা চিন্তাধারাকে সম্ভাবনাবাদ নাম দেন বিখ্যাত ফরাসী ঐতিহাসিক লুসিয়েন ফেভর (Lucien Febvre)। ১৯২২ সালে প্রকাশিত (পরবর্তীকালে ১৯২৪ সালে ইংরাজিতে অনুদিত) তাঁর Geographical Introduction to History নামক গ্রন্থে। কিন্তু French School of Geography তে ভূগোলে সম্ভাবনাবাদ তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন এই পল ভিদাল দ্য লা ব্লাশ (Paul Vidal De La Blache)। তাঁর মানবীয় ভূগোলের অন্যতম গ্রন্থ Principles of Human Geography (Principles de Geographie Humaine) -১৯২১ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর সুযোগ্য ছাত্র ও জামাতা এমানুয়েল দ্য মারতন(১৮৭৩-১৯৫৫) প্রকাশ করেন।

সম্ভাবনাবাদের মূলধারাঃ-

ভিদাল আর ফেভর ইতিহাস ও ভূগোলের মেলবন্ধনের মাধ্যমে যে চিরাচরিত প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রনবাদের বিনাশ ঘটিয়ে নতুন তত্ত্ব প্রকাশ করেন সেখানে মানুষকে প্রধান করে প্রকৃতিকে বিভিন্ন সম্ভাবনার কোষাগার বলে উল্লেখ করেছেন। এই মতবাদে মানুষের মর্যাদাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে বলা হয় যে প্রকৃতির উন্মোচিত সম্ভাবনাগুলিকে মানুষ কিভাবে গ্রহণ ও ব্যবহার করবে তা সম্পূর্ণভাবে মানুষ সিদ্ধান্ত নেবেন। তাঁদের যৌথ মতবাদের সারমর্ম হলঃ “এই বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশ কোন স্থানে সেই স্থানের অধিবাসীদের শুধুমাত্র একটি নয়, একাধিক ভিন্ন ভিন্ন সুযোগ বা সুবিধার দ্বার উন্মোচন করে দেয় এবং সেই স্থানের জনজাতি সেইসব সুযোগ সুবিধার মধ্যে কোনটি গ্রহণ করবে তা নির্ভর করে তাঁদের প্রয়োজন, আদর্শ, ইচ্ছা, রুচি, ক্ষমতা বা সামর্থ্যের উপর। কোন স্থানে মানুষের প্রয়োজনের প্রকৃতি, ইচ্ছা, অনিচ্ছা এবং ক্ষমতা নির্ভর করে সেই স্থানের মানুষের সংস্কৃতি ও সামাজিক আদর্শের উপর”

ভিদালের এই তত্ত্বের বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করার আগে জেনে রাখা দরকার যে সম্ভাবনাবাদের অপর সঙ্গী লুই ফেভর যিনি ভিদালের মৃত্যুর পরে ১৯৩২ সালে চরম সম্ভাবনাবাদের কথা তুলে ধরেন। তাঁর মতে ভিদাল মানুষ প্রকৃতির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আংশিকভাবে পরিবেশগত নিয়ন্ত্রনবাদের সমর্থন করেছেন। তাই তিনি চরমসম্ভাবনাবাদের কথা বলেন যেখানে প্রকৃতি একেবারে নিস্ক্রিয় থাকে। যদিও পরবর্তীকালে এই পরিবেশগত নিয়ন্ত্রনবাদ ও সম্ভাবনাবাদ এর পারস্পরিক বিতর্কের অবসান ঘটাতে অস্ট্রেলীয় ভূবিজ্ঞানী গ্রিফিথ টেলর নবনিয়ন্ত্রনবাদের প্রতিষ্ঠা করেন যা টেলরকে বিশ্বে পরিচিত করে তোলে। প্রকৃতপক্ষেসম্ভাবনাবাদকে ভূগোলে এমনভাবে প্রচার করা হয়েছিল সবার কাছে মনে হয়েছিল যে প্রাকৃতিক পরিবেশগত নিয়ন্ত্রনবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে সম্ভাবনাবাদের জন্ম হয়েছিল। বাস্তবে যেমন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রনবাদকে সমর্থন করা যায় না তেমনি পরিপূর্ণ সম্ভাবনাবাদকে মানা যায় না। তাঁর কারন প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতিবন্ধকতা সবসময় কাটানো সম্ভব হয় নি। মানুষের শিক্ষা সংস্কৃতি রুচির সাথে সভ্য জগতের উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করে প্রকৃতিকে আংশিকভাবে নিয়ন্ত্রন করলেও মনেপ্রাণে প্রকৃতির খামখেয়ালিপনাকে ঝেড়ে ফেলতে পারে নি। সেখানেই সম্ভাবনাবাদের সীমা নির্ধারণ হয়ে যায়। বিশেষ করে যে সকল জনজাতি আজও প্রকৃতির সাথে ওতপ্রতভাবে জড়িত, তারা পরিপূর্ণভাবে পরিবেশের উপর নির্ভর করে, পরিবেশের নিয়ন্ত্রনকে প্রাধান্য দেয়।

আমাদের সভ্য জগতের মানুষ নিজের শিক্ষার সাহায্যে মরুভূমিতে ক্যানাল কেটে সবুজের সমারোহ করেছে, কিংবা হিমালয়ের চুড়ায় তাঁর দেশের পতাকা দিতে পেরেছে, সাগরের অতল তলে ডুব দিয়ে তুলে এনেছে মহামূল্যবান রত্নসামগ্রী কিন্তু কোনটাই যেমন প্রকৃতি নিয়ন্ত্রনের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয় না (যদি প্রকৃতি নিজে না চায়) তেমনি মানুষও নির্ভয়ে প্রকৃতির বুকে বিচরণ করতে পারে না, আজও পারছে না বিজ্ঞানের উন্নত প্রযুক্তি হাতে নিয়েও। তাই বিজ্ঞানী ও. এইচ. কে. স্পেট (১৯৫৭) এর বক্তব্যে বিজ্ঞানভিত্তিক সম্ভাবনাবাদ এর কথা উঠে আসে। আমরা যদি এখনো সচেতন না হতে পারি, একদিন হয়তো বিশ্বের অন্যতম আরল সাগরের মতো কোলাহলপূর্ণ জল শুকিয়ে রিক্ত হয়ে মরুতে পুড়তে হবে।

লেখকঃ সনৎকুমার পুরকাইত, সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, রায়দিঘি কলেজ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)।

©Mission Geography India

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত