ভূমিরূপগত একটি মিশ্র বৈশিষ্ট্য অঞ্চল রাঢ় সমভূমি

ভূমিরূপগত একটি মিশ্র বৈশিষ্ট্য অঞ্চল : রাঢ় সমভূমি

পর্বত, মালভূমি, সমভূমি — প্রধান তিনটি ভূমিরূপ হলেও ভূপ্রাকৃতিক দিক থেকে কিছু মধ্যবর্তী মিশ্র অঞ্চল লক্ষ্য করা যায়। যেমন — পর্বতের পাদদেশীয় সমভূমি, মালভূমির পাদদেশীয় সমভূমি। এগুলির বিভিন্ন নাম রয়েছে, যেমন — ভাবর, তরাই প্রভৃতি। পশ্চিমবঙ্গের মালভূমি ও সমভূমির মধ্যবর্তী মিশ্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পৃথক অঞ্চল রাঢ় সমভূমি নামে পরিচিত।

♦অবস্থানঃ-
পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমের মালভূমি (যা ছোটোনাগপুর মালভূমির অংশ) এবং পূর্বের গাঙ্গেয় সমভূমি মধ্যবর্তী অঞ্চলটি ‘রাঢ়’ নামে পরিচিত। রাঢ় অঞ্চলের সীমানা সম্পর্কে মতবিরোধ থাকলেও, এর বেশিরভাগ অংশ পশ্চিমবঙ্গে এবং কিছু অংশ ঝাড়খন্ডে (সাঁওতাল পরগনা অঞ্চল) অবস্থিত। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, পূর্ব মেদিনীপুর ও পূর্ব বর্ধমান জেলার পশ্চিমাংশ ; বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, পশ্চিম বর্ধমান, ঝাড়গ্রাম, বীরভূম জেলার পূর্বাংশ এবং হুগলি জেলার পশ্চিমের সামান্য অংশ রাঢ় সমভূমির অন্তর্গত। সমগ্র অঞ্চলটির আয়তন ৩৭৭ বর্গকিমি।

♦বুৎপত্তিগত অর্থঃ-
প্রচলিত মতে, সাঁওতাল শব্দ ‘রাড়ো’ থেকে রাঢ় শব্দটির উৎপত্তি, যার অর্থ — পাথুরে জমি। তবে শব্দটির অনেক বিকৃতি লক্ষ্য করা যায়। যেমন — রাঢ > রাঢা > রাঢ়া > রাড় > লাঢা > লাঢ় ইত্যাদি। সাঁওতালি ভাষা ‘লার’ (সুতো), ‘রাঢ়’ (সুর) ও ‘লাঢ়’ (সাপ) থেকেও ‘রাঢ়’ শব্দটি এসেছে বলে অনেকের মত। তবে প্রভাতরঞ্জন সরকারের মতে, শব্দটির উৎস প্রোটো অস্ট্রো-এশিয়াটিক ‘রাঢ়া’ ও ‘রাঢো’ শব্দদ্বয়। এর অর্থ লালমাটির দেশ।

ভৌগোলিক দিক থেকে বলা যায়, পশ্চিম মালভূমি অঞ্চলটি গ্রানাইট ও নিস শিলা দ্বারা গঠিত হওয়ায়, এখানের মাটি লাল রঙের। এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদনদীগুলি লালমাটি বহন করে মালভূমির পাদদেশীয় অঞ্চলে সঞ্চয় করে সমভূমি গঠন করেছে। তাই এর নাম রাঢ় সমভূমি।

♦প্রাচীন কালের রাঢ় অঞ্চলঃ-
অতীতে তৎকালীন বাংলায় ভাগীরথীর পশ্চিমের প্রাচীন জনপদ ছিল রাঢ়। এটি দুইভাগে বিভক্ত — উত্তর রাঢ় এবং দক্ষিন রাঢ়। জৈনদের প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে, উত্তর রাঢ় ব্রজভূমি নামে পরিচিত। এটি বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার পশ্চিমাংশ, বীরভূম জেলার সাঁওতাল পরগণার অংশ, বর্ধমানের কাটোয়া মহকুমার উত্তর ভাগ নিয়ে গঠিত ছিল। দক্ষিন রাঢ় অঞ্চল সূক্ষভূমি নামে পরিচিত ছিল। হাওড়া, হুগলি ও বর্ধমান জেলার বাকি অংশ, অজয় ও দামোদর নদের মধ্যবর্তী অংশ নিয়ে গঠিত ছিল। বলা হয় এই অঞ্চলে ‘গঙ্গারিডাই’ রাজ্য ছিল, তবে তার বিশেষ প্রমাণ পাওয়া যায়না।

♦রাঢ় অঞ্চলের বর্তমান জেলাসমূহঃ-
দামোদর নদ রাঢ় সমভূমিকে দুইভাগে ভাগ করেছে —
(১) উত্তর রাঢ়ঃ- মুর্শিদাবাদ, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূম জেলা এর অন্তর্গত।
(২) দক্ষিন রাঢ়ঃ- এর মধ্যে রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও ঝাড়গ্রাম জেলা এর অন্তর্গত।

♦রাঢ় অঞ্চলের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যঃ-
কোথাও সমতল, কোথাও বা মৃদু ঢেউ খেলানো রাঢ় সমভূমির গড় উচ্চতা ৫০-১০০ মিটার। এর ঢাল পশ্চিম থেকে পূর্বে হওয়ায় ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর, দ্বারকেশ্বর, শিলাই, কাঁসাই প্রভৃতি অনিত্যবহ নদনদী গুলি ছোটোনাগপুর মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পূর্বে ভাগীরথী-হুগলি নদীতে পতিত হয়েছে। কেবলমাত্র সুবর্ণরেখা বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। নদনদী বাহিত লাল কাঁকুরে পলি দিয়ে রাঢ় সমভূমি সৃষ্টি হওয়ায় মাটির স্তর অগভীর, জলধারণ ক্ষমতা কম, নদী অববাহিকা অঞ্চল বাদে মৃত্তিকা অনুর্বর। এখানকার গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন গড় উষ্ণতা যথাক্রমে ৩৫-৪০ ডিগ্রি C এবং ১২-১৪ ডিগ্রি C। দক্ষিন-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এখানে গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১৪০-১৬০ সেমি। সমুদ্র থেকে দূরে অবস্থানের কারনে জলবায়ু চরমভাবাপন্ন। বৃষ্টিপাত ও উষ্ণতার ওপর নির্ভর করে রাঢ় অঞ্চলে শাল, শিমূল, মহুয়া, কুল, বাঁশ, শিরীষ প্রভৃতি শুষ্ক পর্ণমোচী অরণ্য ও ঝোপঝাড় দেখা যায়। অতীতে এই অঞ্চল অরণ্য সংকুল থাকলেও, চাষাবাদ ও অন্যান্য কারনে অতিরিক্ত বনছেদনের ফলে ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পেয়েছে।

♦রাঢ় অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক বৈশিষ্ট্যঃ-
নদী অববাহিকা অঞ্চলগুলিতে ধান, গম, আখ, ডাল, তৈলবীজ, আলু প্রভৃতি ফসল ব্যাপক ভাবে চাষ হয়। এছাড়াও দুই মেদিনীপুরে পান ও সবজি, বাঁকুড়ায় পলাশ ও কুল গাছে লাক্ষাকীট, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদে তুঁতগাছের চাষ হয়। কৃষি ছাড়াও এই অঞ্চলে খনিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে রাণীগঞ্জের কয়লা, বীরভূমের মহম্মদবাজার, হুগলির কামারপুকুর, বাঁকুড়ার মেজিয়ায় অভ্র, চিনামাটি ও ফায়ার ক্লে পাওয়া যায়। ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি থেকে ম্যাঙ্গানিজ, পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, হুগলি, বাঁকুড়ার বিভিন্ন খাদ থেকে বালি তোলা হয়। রাঢ় অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য শহরের মধ্যে রয়েছে — বর্ধমান, দুর্গাপুর, আসানসোল, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর ইত্যাদি। মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এই অঞ্চলের প্রধান শক্তিসম্পদ কেন্দ্র। রাঢ় অঞ্চলের প্রধান লৌহ-ইস্পাত শিল্পকেন্দ্র হল দুর্গাপুর, যা ভারতের রূঢ নামে পরিচিত। এছাড়াও কিছু ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মধ্যে রয়েছে — বাঁকুড়া ও বীরভূমের পোড়ামাটি ও টেরাকোটার কাজ, মুর্শিদাবাদের হাতির দাঁত ও রেশম শিল্প, বিষ্ণুপুরের রেশম ও তসর শিল্প, পশ্চিম মেদিনীপুরের মাদুর শিল্প, হুগলির তাঁত শিল্প প্রভৃতি।

♦বর্তমান ও ভবিষ্যৎঃ-
রাঢ় অঞ্চল ক্রমাগত বিভিন্ন ক্ষেত্রে পৃথক আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বহন করে চলেছে। বর্তমানে সরকারি নীতিতে এই অঞ্চলের পর্যটন শিল্পের ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাঁকুড়ার বিহারীনাথ, শুশুনিয়া, মুকুটমণিপুর ; বীরভূমের মামা-ভাগ্নে পাহাড় ; পশ্চিম মেদিনীপুরের গনগনি ; ঝাড়গ্রামের রাজবাড়ী, চিল্কিগড় প্রভৃতি দর্শনীয় স্থান। পশ্চিম বর্ধমানের অন্ডালে বিমানবন্দর নির্মাণ করা হয়েছে এবং সংলগ্ন অঞ্চলে ভারতের প্রথম অ্যারোট্রোপলিস হিসেবে অন্ডাল অ্যারোট্রোপলিস গড়ে উঠেছে, যা ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করেছে।

লেখিকাঃ- সূচনা ব্যানার্জী (মসাগ্রাম, পূর্ব বর্ধমান)
প্রথম প্রকাশঃ ভূগোলিকা ফেসবুক পেজ, দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি-৩০/০৩/২০১৯

তথ্যসূত্রঃ- ভূগোল প্রবেশ – ডঃ সুভাষরঞ্জন বসু ; মাধ্যমিক ভূগোল – রণজিৎ গরাং ; উইকিভ্রমণ – Wikipedia ; ভারতের ইতিহাস – অতুলচন্দ্র রায় ; বাংলাপিডিয়া

©Mission Geography India
©ভূগোলিকা-Bhugolika

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত