বিশ্বের সর্ববৃহৎ মহিলা পরিচালিত বাজার মনিপুরের Ima Keithal
প্রিয় পাঠক, আপনাদের সামনে আজ এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করব যেটা হয়তো অনেকের জানা নেই। আমরা নারী স্বাধীনতার জন্য কি না করেছি। ইতিহাস সাক্ষী আছে নারীর ত্যাগ, তিতিক্ষা, নারীর আন্দোলন, সমানাধিকারের দাবিতে সোচ্চার হওয়া, পুরুষের সাফল্যে নারীর অবদান আবার পক্ষান্তরে দেখেছি এই নারীর কারনে ইতিহাসে বড় বড় সভ্যতা কিভাবে বিনাশ হয়েছে। নারীর বৈশিষ্ট জানতে আমরা সাহিত্যচর্চা করেছি। কিন্তু আজ আপনাদের সামনে সম্পূর্ণ এক অন্য আঙ্গিকে নারীর ভূমিকা তুলে ধরব যা সারা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল থেকে বিরলতম।
আমাদের দেশের একেবারে উত্তরপূর্ব কোণের সাতটি রাজ্যের একটি রাজ্য মণিপুর। মণিপুর রাজ্যের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার বীরত্বের কথা আমরা মহাভারতের পাতা থেকে জেনেছি। সেই মনিপুরের রাজধানী অঞ্চল ইম্ফলের কেন্দ্রবিন্দুতে আমরা দেখতে পাই একটি প্রায় ৫০০ বছরের পুরানো বাজার Ima Keithal যেখানে পাঁচ হাজারের বেশী দোকানদার বা ব্যবসায়ী মহিলা। কোন পুরুষ দেখতে পাবেন না। পুরো বাজারটাই মহিলা পরিচালিত। সে বাজারে কি নেই? আধুনিক রুচির পোশাক, ফল, সব্জি থেকে শুরু করে সকল প্রকার মশলা ও দৈনন্দিন জীবনের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাওয়া যায়। মনিপুরের ইতিহাসে এই Ima Keithal যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায় মাতৃ বাজার সারা এশিয়া তথা সারা বিশ্বের মধ্যে বৃহত্তম বাজার যেখানে একসাথে পাঁচ হাজারের উপর ব্যবসায়ী এক ছাদের তলায় এবং তাঁরা সবাই মহিলা।
এই Ima Keithal এর উৎপত্তি নিয়ে গবেষক সঞ্চারী পালের অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে পাঁচ শতকের এই পুরানো মহিলা পরিচালিত বাজারের জন্ম হয়েছিল মনিপুরের একটি প্রাচীন প্রথা Lallup-Kaba থেকে যার ফলশ্রুতি হিসাবে ১৬ শতকে মনিপুরের পুরুষদের কাজের জন্য দুরদেশে চলে যেতে হত। অথবা দেশের প্রান্তিক এলাকায় রুক্ষ্ম ভুমি কর্ষণের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হত বা যুদ্ধ বিগ্রহের কাজে নিয়োজিত করা হত। গ্রামে পড়ে থাকতো পরিবারের মহিলা ও শিশু সন্তানরা। প্রথম দিকে সংসারের হাল ধরতে বাড়ির মহিলারা নিজ নিজ জমিতে চাষআবাদ করে বাজারে রপ্তানি করতেন। ধীরে ধীরে মনিপুরের কেন্দ্রস্থলে তৈরি হয়ে গেল একটি সাপ্তাহিক বাজার যার মুলে এই স্থানের সকল মহিলারা। এভাবেই গড়ে ওঠে সারা বিশ্বের আশ্চর্য মহিলা পরিচালিত মনিপুরের এই বাজার Ima Keithal ।
ঔপনিবেশিককালে ব্রিটিশ প্রশাসক একতরফাভাবে মনিপুরের ব্যবসায়িক সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মনিপুরের মহিলাদের পরিশ্রমে ফলানো বিশাল পরিমাণ চাল স্থানীয় বাসিন্দাদের চাহিদার কথা মাথায় না রেখে সব পাঠিয়ে দেওয়া হত নিকটবর্তী ব্রিটিশ সেনা ছাউনিতে। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে অনাহারে মৃত্যুবরণ করার থেকে একসাথে সোচ্চার হয়ে ওঠেন মনিপুরী মহিলারা। ১৯৩৯ সালে প্রথম মহিলাদের সহিংস আন্দোলনের পথ বেছে নেন যেটাকে স্থানীয় ভাষায় Nupi Lan বা মহিলা বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
Nupi Lan এর সময় থেকে মনিপুরের এই Ima Keithel এর মহিলা ব্যবসায়ীরা সভা, সমিতি, হরতাল, ধর্মঘট, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে থাকে। তাঁদের মূল দাবী ছিল স্থানীয় শাসক তথা পরোক্ষভাবে ব্রিটিশ শক্তির হাত ধরে অর্থনৈতিক নীতির পরিবর্তন করে স্থানীয় লোকের স্বার্থরক্ষা করা।এই সকল প্রতিবন্ধক্তার মাঝে ব্রিটিশরা একদিন ঠিক করল Ima Keithel এর সুবিশাল বিল্ডিংটা বিদেশিদের কাছে বিক্রি করে দেবেন, কিন্তু হিংস্রভাবে সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে এই সিদ্ধান্ত রদ করেন মনিপুরের মহিলা ব্যবসায়ীরা। সেই কারনে এটা একটা বাজারের থেকে মনিপুরের সংস্কৃতির অঙ্গ বলা বেশি ভাল। এই মহিলা বিদ্রোহ ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে যখন মণিপুর একটি জাপান ও যৌথবাহিনির যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়।
যাইহোক মনিপুরের ইতিহাসে তথা বিশ্বের সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাসে Ima Keithel রক্ষার্থে Nupi Lan বা মনিপুরী মহিলাদের সংগঠিত আন্দোলন একটি নিদর্শন হয়ে আছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সকল মহিলা পরিচালিত বাজারগুলি হয়ে দাঁড়ায় এক একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক ধ্যান ধারনা তথা মত বিনিময়ের কেন্দ্র। আজকের মত যখন মিডিয়ার এত প্রভাব ছিল না তখন রাজ্যের মানুষ Ima Keital এ জড়ো হতেন শুধু গুরুত্বপূর্ণ খবর জানতে বা তথ্যের আদান প্রদান করতে। আজও পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায় যে মনিপুরের অর্থনীতিতে স্থানীয় মহিলাদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
Ima Keital মনিপুরের বাইরের রাজ্য তথা দেশের বাইরের ভ্রমণ পিপাসু মানুষের আগমনে মনিপুরের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী তথা এখানকার হাতের কাজ ও চিত্রকলা বা ক্ষুদ্র ও কুটীর শিল্পের সামগ্রী বা ভিন্ন রুচির পোশাক ও খাবার যোগান দিয়ে বিশ্বের বাজারে সুনাম অর্জন করেছে। যদিও ২০১৬ সালের ৪ ঠা জানুয়ারিতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে এই কর্মকাণ্ডের ছন্দপতন ঘটে সাময়িকভাবে।
বলা বাহুল্য, এই বহুজাতিক বাজারে কেবলমাত্র বিবাহিত মহিলারাই ব্যবসায়িক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারেন। এই পরম্পরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেয়ে চলেছে। দূরের গ্রাম থেকে আগত এক জনৈক ব্যবসায়ীর কথায় একটা ছোট জায়গার জন্য মাসে ৪০ টাকা করে ভাড়া দিতে হয়। আরও শুনলে অবাক হতে হয়, যে এই Ima Keital এর সকল ব্যবসায়ী মিলে একটি ইউনিয়ন চালায় যারা এই বাজারের ভালমন্দ দেখভাল করার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের টাকা পয়সা লোণ হিসাবে দিয়ে থাকে যেটা আবার তাঁরা সময় করে ইউনিয়নে ফেরত দিয়ে দেয়।
এই Ima Keithal সবদিক থেকে মনিপুরী মহিলাদের কাছে দ্বিতীয় পরিবার বললে কম বলা হয়। সারাদিনের বেচাকেনা, সুখ দুঃখ, হাসি ঠাট্টা, লাভ লোকসান, হিসাব নিকাশের মাঝেও এই বাজার আজ প্রায় ৫০০ বছর ধরে মনিপুরের সাংস্কৃতিক পীঠস্থান হিসাবে কাজ করে আসছে। এখানে বাৎসরিক অনুষ্ঠান ও মানুষের মেলবন্ধনের জন্য নানাধরনের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তাঁরা এই স্থান অর্থাৎ Ima Keithal কে বাজারের রানি বলে মেনে আসছে।
আমার বক্তব্য এখানেই যে, বর্তমানে আমাদের দেশের তথা রাজ্যের মহিলারা সকল স্তরে সংরক্ষন ও সমানাধিকারের দাবিতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে বা সেই সংরক্ষনের সুবিধা ভোগ করছে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁর অপব্যবহার করতে পিছপা হয় না, সেখানে দেশের একেবারে প্রান্তিক রাজ্য মনিপুরের মহিলারা নিজের কর্তব্যজ্ঞানে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। নেই তাঁদের কোন সরকারী সুবিধা, তাঁদের কাছে কোন ক্যাজুয়াল লিভ নেই, ম্যাটারনিটি লিভ নেই, নেই কোন সিসিএল, নেই কোন কর জমার ক্ষেত্রে আলাদা করে ছাড় বা ব্যবসায়িক কোন সুযোগ সুবিধা আলাদা করে মেলে না। তার পরেও তাঁরা নিজেদের অর্থনীতির দায়ভার নিজেদের হাতে রাখে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তাঁরা কোন সংরক্ষনের হাত ধরে চাকরীর তোয়াক্কা না করে স্বাধীন ব্যবসার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে সদিচ্ছা থাকলে সবকিছু করা যায়। মজার বিষয় হচ্ছে এরা আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন না, উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, অবিবাহিতা মেয়েদের এই বানিজ্যিক কাজকর্মে অনুমতি দেন না। তথ্য ও ছবির জন্য গুগলের কাছে কৃতজ্ঞ। পরিশেষে বলি, এখানে কোন মহিলাকে আঘাত দেওয়ার জন্য নয়, সম্পূর্ণ বিশ্লেষণাত্মক একটি প্রতিবেদন। যদি কারুর খারাপ লাগে নিজ গুনে ক্ষমা করবেন প্লিজ।
লেখকঃ অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত (রায়দিঘি কলেজ, দক্ষিণ ২৪ পরগণা)