পরিবর্তনের পথে পৃথিবী

করোনা ভাইরাসের আক্রমণ নিয়ে সারাদেশ তথা বিশ্ব আজ গভীর সংকটের মুখে। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ আজ ঘরবন্দী। মানুষের সভ্যতার অহংকার যেন চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে না পারলে প্রকৃতি নিজে থেকেই সেই ভারসাম্য বজায়ের পথ খুঁজে নেবে। আমরা যেন কখনোই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত সাবধানবানী না ভুলে যাই — “বর্তমানে আমরা সভ্যতার যে প্রবণতা দেখি, তাতে বোঝা যায় যে, সে ক্রমশই প্রকৃতির সহজ নিয়ম পেরিয়ে বহুদূর চলে যাচ্ছে।…প্রকৃতিকে অতিক্রমণ কিছুদূর পর্যন্ত সয়, তারপরে আসে বিনাশের পালা।” (উপেক্ষিতা পল্লী, ১৯৩৪)
পৃথিবী আজ বিভিন্ন পরিবেশগত সমস্যার সম্মুখীন। পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা IUCN তাদের সমীক্ষাপত্রে পৃথিবীর পরিবেশগত সমস্যার জন্য সামগ্রিক ভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের দিকটির বিষয়ে আলোকপাত করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন বললে সমগ্র পৃথিবীর, বিশেষ করে উন্নত ও উন্নতশীল দেশের মানুষের কার্যাবলী এবং তার ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধিকে ইঙ্গিত করে। শুধুমাত্র তাপমাত্রা বৃদ্ধি নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হিসাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন উপাদানের যেমন — বায়ুর চাপ, বায়ু প্রবাহ, অধঃক্ষেপণ, আর্দ্রতা প্রভৃতি বিষয় জলবায়ু পরিবর্তনের সূচক হিসাবে কাজ করে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কিছু কারণঃ-
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে বেশ কিছু প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার উপর এই পরিবর্তন নির্ভর করে। পৃথিবীর গতিশীল প্রভাব এবং বহির্জগতের প্রভাবের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন বিষয় হল — সৌর বিকিরণের মাত্রা এবং পৃথিবীর অক্ষরেখার দিক পরিবর্তন অথবা সূর্যের তুলনায় পৃথিবীর অবস্থান।শুধু তাই নয়, আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল হিমবাহের হ্রাসবৃদ্ধি। প্রায় তিরিশ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে পর্যায়ক্রমে হিমযুগ ও অন্তর্বর্তীকালীন উষ্ণযুগের সূত্রপাত ঘটে। দেখা গেছে দুটি উষ্ণ যুগের চূড়ান্ত পর্যায়ের মাঝে সময় থাকে আনুমানিক গড়ে এক লক্ষ বছর। এই ঘটনার কারণ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও সাধারণ ভাবে মনে করা হয় পৃথিবীর মহাদেশগুলির পারস্পরিক অবস্থান, পৃথিবীর অক্ষরেখা ও কক্ষপথের পরিবর্তন এর জন্য মূলত দায়ী।
এবার অন্য কথায় আসি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্পবিপ্লবের পর আশ্চর্যজনক ভাবে বদলে গেলো পৃথিবীর শিল্প মানচিত্র। পরিবেশ বান্ধব মনোভাব ভুলে মানুষের জীবনযাত্রা পাড়ি দিল অন্ধকার কালো ধোঁয়াভরা পরিবেশের পথে। বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের আর একটি প্রধান কারণ হিসেবে ততদিনে জায়গা করে নিয়েছে বনভূমির সংকোচন। নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের ফলে প্রতিবছরই পৃথিবীতে ৪.৬ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে। রাষ্ট্রসংঘের হিসাবে প্রতি মিনিটে ধ্বংস হচ্ছে প্রায় দশ হেক্টর বনভূমি। তার সাথে যোগ দিচ্ছে শিল্প কারখানা থেকে নিঃসৃত গ্যাসগুলিও। ফলস্বরূপ বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড জাতীয় গ্যাসগুলো বেড়ে যাচ্ছে, যাদের আমরা বর্তমানে গ্রিনহাউস গ্যাস হিসেবে চিহ্নিত করেছি। যখন খেয়াল হল, তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। ১৯৭২ সালে স্টকহোম বসুন্ধরা সম্মেলনে আলোচনায় উঠে এল বায়ুদূষণ এবং জলদূষণের ভয়াবহ পরিণতির দিক।

প্রভাবঃ-
জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণের কারণে বিভিন্ন মহাসাগরগুলোতে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের উপর। ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে জলজ প্রাণীদের স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্র। সমীক্ষায় দেখা গেছে ১৯৬০ সালে অক্সিজেন স্বল্পতার মধ্যে মাত্র ৪৫ টি সামুদ্রিক এলাকা ছিল, ২০১৯-তে তা এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০০ টি সামুদ্রিক এলাকাতে। বর্তমানে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে পৃথিবী যে বিপদের সম্মুখীন — সে বিষয়ে রাষ্ট্রসংঘের একদল বিজ্ঞানী সাবধানবানী শুনিয়েছেন। সাম্প্রতিক আইপিসিসি (IPCC) বা জলবায়ু বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্যানেলে বলা হয়েছে যদি বিশ্বের তাপমাত্রা এই দশকের শেষের দিকে ১.৫ ডিগ্রি বেড়ে যায় তাহলে তার প্রভাব সমুদ্রের বরফ আচ্ছাদিত অঞ্চলের উপরই পড়বে বেশি। সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার কারণে বরফ গলে গেলে তার প্রভাব কিন্তু প্রাণী জগতের উপরই এসে পড়ছে। বাড়ছে গ্রিনল্যান্ড ও আন্টার্কটিকার গলন –ফলস্বরূপ বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। ২০০৭ সালের আগের দশ বছর যে তুলনায় বরফ গলেছে তার পরের দশ বছর অর্থাৎ ২০১৬ সাল পর্যন্ত তার তিনগুন বরফ গলেছে। আশঙ্কার বিষয় এটাই যে, আগামী ২১০০ সালের মধ্যে ইউরেশিয়া, উত্তর এশিয়া এবং আন্দিজ সহ উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলের প্রায় ৮০% বরফ গলে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। হিমবাহ গলনের ফল স্বরূপ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে নিচু উপকূলীয় এলাকাগুলি ডুবে যাবার সম্ভাবনা প্রবল।

IPCC এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হয়েছে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ১.১ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। শুধু তাই নয় সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনাও বাড়বে এবং বিপদের সম্ভাবনা নজিরবিহীন জায়গায় চলে যেতে পারে। বরফ গলনের ফলে হাজার বছর আগের জমে থাকা ভয়ঙ্কর ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া সমুদ্র জলে বা বাতাসে মিশে বিভিন্ন অসুখের জন্ম দেবে। বন্যা ও খরা বাড়বে অকল্পনীয় হারে। আর সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীর ৯০% প্রবালপ্রাচীর প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মাছ ও জলজ উদ্ভিদের উপর বাড়বে আরও নেতিবাচক প্রভাব। আশার কথা একটাই শুনিয়েছেন তাঁরা — কার্বন নিঃসরণের পরিমান ৪৫% কমিয়ে ফেলতে পারলেই হয়তো জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ঙ্কর প্রভাব লাঘব করতে পারবে পৃথিবী। চরম ঝুঁকির মধ্যে থাকা মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।

বাস্তুতন্ত্র বিনাশ ও ধ্বংসের পথঃ-
১৯৬০ সালের পর থেকে কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশক ও রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার শুরু হয়। সবুজ বিপ্লবের সাফল্যে ভারত তথা সারা বিশ্বে কৃষিতে বিপ্লব আসে।ফলস্বরূপ ভূ-বৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে। কেঁচোর মতো বহু কীটপতঙ্গ ধীরে ধীরে বাস্তুতন্ত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, পৃথিবী থেকে মৌমাছি লুপ্ত হলেই ধরে নিতে হবে পৃথিবীর আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে আসছে। কারণ পরাগরেণুর মিলন বন্ধ হলেই ঘটবে বাস্তুতন্ত্রের বিনাশ। ক্রম পরিবর্তনশীল পৃথিবী বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য হারাচ্ছে। বহু প্রজাতি লুপ্ত হয়ে গেছে, বহু লুপ্তপ্রায়। বর্তমান বায়ুদূষণের ফলস্বরূপ মুক্ত ও বিশুদ্ধ বায়ুর অভাবে সারা পৃথিবীর জনস্বাস্থ্য বিপর্যস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত। ভাসমান ধূলিকণা (অ্যারোসল), সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, ওজোন, সীসা, অ্যামোনিয়া, বেঞ্জিন, আর্সেনিক, নিকেলের উপস্থিতি জনস্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেই চলেছে। মেডিক্যাল সায়েন্সের অগ্রগতি সেই বেহাল দশার কিছুটা মোকাবিলা করে, প্রতিবন্ধকতাকে খানিকটা দূরে সরিয়ে রেখেছে মাত্র। জনসংখ্যা বাড়ছে, নগরায়ণ বাড়ছে, কৃষিক্ষেত্র বাড়ছে, শিল্প কারখানা বাড়ছে, বনাঞ্চল পুড়ছে, ভূ-গর্ভের জলস্তর শেষ হচ্ছে। পরবর্তী দশ বছর পর জলসংকট পৃথিবীকে এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে, যা আমরা কল্পনাও করে উঠতে পারছি না।

আশার কথা, সুস্থায়ী উন্নয়নকে মেনে চলা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা, দূষণ নিয়ন্ত্রক বোর্ড তৈরি… এইসব হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। নিয়মিত আর্থ সামিট বা বসুন্ধরা সম্মেলনে নীতি নির্ধারণ হচ্ছে পরিবেশকে বাঁচানোর তাগিদে। উন্নত দেশ, উন্নয়নশীল দেশ ও অনুন্নত দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, প্যারিস জলবায়ু চুক্তির মতো চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে। পরিশেষে বলি, মানুষ যতই পরিবেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাক, একদিন প্রকৃতি নিজেই নিজের অস্তিত্ব রক্ষার দায় নিজের কাঁধেই তুলে নেবে। শেষ হয়ে যাবে অতি উন্নত এই মানব সভ্যতা। বাঁচার পথ বোধহয় এটাই, কবির কথাই বারবার মনে পড়ে —
“দাও ফিরে সে অরণ্য ,লও এ নগর”।

লেখিকাঃ- অনিন্দিতা সাউ (খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর)
[লেখিকা পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়ী হাইস্কুল (উঃ মাঃ) -এর ভূগোল শিক্ষিকা]
তথ্যসূত্রঃ- বিবিসি ; Wikipedia

প্রথম প্রকাশঃ ভূগোলিকা ফেসবুক পেজ, তৃতীয় বর্ষপূর্তি-৩০/০৩/২০২০

©ভূগোলিকা-Bhugolika
©মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

অনিন্দিতা সাউ

খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর [লেখিকা পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়ী হাইস্কুল (উঃ মাঃ) -এর ভূগোল শিক্ষিকা]

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত