উষ্ণ আবহাওয়া ও করোনা ভাইরাস
♦সূচনা পর্বঃ- ২০১৯ সালের নভেম্বর মাস থেকে চীনের উহান প্রদেশে এক ভয়াবহ মহামারী ভাইরাস এর সংক্রমণ শুরু হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০৯ সালের সোয়াইন ফ্লু’র পর এই ভাইরাসকে ‘পৃথিবীব্যাপী মহামারী’ (Pandemic) আখ্যা দিয়েছে। এই ভাইরাসের নাম হল করোনা-১৯ ভাইরাস। যার আঁতুড়ঘর চীনের উহান প্রদেশ হলেও, উপকেন্দ্র ইউরোপের ইতালি দেশকে বলা যায়। সেখানে এই ভাইরাসের প্রভাবে মৃত্যুর সংখ্যা সর্বাধিক (৭৫০৩, ২৬.০৩.২০২০ পর্যন্ত)। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুয়ের (যার প্রভাবে প্রায় ৫-৭ কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটে) পর এই ভাইরাসটি বিশাল মারণ আকার ধারণ করে চলেছে। যদিও এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ বছরের উপর বয়সীদের উপর সবচেয়ে বেশি। ইতালিতে জাপানের পর বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধ মানুষের বসবাস (২৩ শতাংশ)।
♦প্রথমে জানা যাক করোনা ভাইরাস এর উৎপত্তি কিভাবে হলোঃ-
বিবিসি নিউজের মত অনুসারে, এই ভাইরাসটি কোনো এক প্রাণী থেকে মানুষের দেহে ঢুকেছে এবং একজন থেকে আরেকজনের দেহে সংক্রমিত হওয়ার সাথে নিজেও পরিবর্তিত হচ্ছে। যাকে বলে মিউটেশন। সার্স বা এবোলার মতো নানা ধরণের প্রাণঘাতী ভাইরাসের খবর মাঝে মাঝেই সংবাদ মাধ্যমে আসে। এই করোনা ভাইরাস তার মধ্যে সর্বশেষ।
♦করোনা ভাইরাস কি এবং কিভাবে ছড়ায় ?
করোনা ভাইরাস এমন একটি সংক্রামক ভাইরাস যা এর আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি। ভাইরাস টির আরেক নাম ২০১৯-এনডিওভি । এটি এক ধরণের করোনা ভাইরাস। করোনা ভাইরাসের অনেক রকম প্রজাতি আছে কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৭টি মানুষের দেহে সংক্রামিত হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি হয়তো মানুষের দেহকোষের ভেতরে ইতিমধ্যেই “মিউটেট করেছে” অর্থাৎ গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিচ্ছে এবং সংখ্যা বৃদ্ধি করছে। এই ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই এটি একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায়। সাধারণ ফ্লু বা ঠান্ডা লাগার মতো করেই এই ভাইরাস টি ছড়ায় হাঁচি, কাশির মাধ্যমে।
এক দশক আগে সার্স (পুরো নাম সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) নামে যে ভাইরাস এর সংক্রমণে পৃথিবীতে প্রায় ৮০০ জন লোকের মৃত্যু হয়েছিল সেটিও ছিল এক ধরণের করোনা ভাইরাস।
♦আক্রান্ত ব্যাক্তির দেহে কি লক্ষণ দেখা যায় ?
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের প্রধান লক্ষণ হলো শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, জ্বর এবং কাশি। কিন্তু এর পরিণামে অর্গান ফেলিওর বা দেহের বিভিন্ন প্রতঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া, নিউমোনিয়া এবং মৃত্যু ঘটে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি শরীরে ঢোকার পর সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিতে প্রায় পাঁচ দিন লাগে। প্রথম লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। তারপর দেখা দেয় শুকনো কাশি। এক সপ্তাহের মধ্যে দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট এবং তখন কোনো কোনো রোগীকে হসপিটালে ভর্তি হতে হয়।
♦এর কি কোনো চিকিৎসা আছে ?
যেহেতু এই ভাইরাসটি নতুন, তাই এর কোনো টিকা বা ভ্যাকসিন এখনো পর্যন্ত নেই এবং এমন কোনো চিকিৎসা নেই যা এই রোগ ঠেকাতে পারে।
♦উষ্ণ আবহাওয়া ও করোনা ভাইরাসঃ-
টাইমস ম্যাগাজিন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, উষ্ণ আবহাওয়া এই ভাইরাস এর বিস্তার কে প্রভাবিত করবে কিনা এখনো নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। প্রতিবেদনে পেনসিলভেনিয়া স্টেট উনিভার্সিটির সংক্রামক রোগ ডাইনামিক্স কেন্দ্রের পরিচালক এলিজাবেথ মাকঘরভের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে, এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কখন এবং কিভাবে শেষ হবে তা নির্ধারণ করার জন্য অনেক বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। ভাইরাস সংক্রমণের হার, সংক্রমণের পদ্ধতি গুলির কার্যকরিতা, আবহাওয়া এবং মানব প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্ভবত তার ভারসাম্যতা নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে।
আর্দ্রতা এবং তাপমাত্রা বাড়িয়ে করোনার বিস্তার কমানো সম্ভব বলে দাবি করছেন চীনের একদল গবেষক। তবে শুধুমাত্র আবহাওয়া পরিবর্তনের মাধ্যমেই এই ভাইরাসের প্রকোপ একেবারে বন্ধ করা সম্ভব নয়। চীনের বেইহাং এবং সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষকরা বলছেন, চীনের শতাধিক শহরে আবহাওয়া উষ্ণ এবং সেখানকার আদ্রতা বাড়তে থাকায় কোভিড-১৯ এর প্রকোপ কমেছে।
গবেষকরা বলছেন, শীতকালীন আবহাওয়া ঠান্ডা, কাশি এবং জ্বরের মতো উপসর্গগুলো বেড়ে যায়। এসময় ভাইরাস খুব সহজেই বিস্তার লাভ করতে পারে এবং শরীরে হানা দিতে পারে। কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে ভাইরাস দ্রুত বিস্তার লাভ করতে পারে না।
চিনে যখন এই ভাইরাসের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছিল তখন সেখানকার তাপমাত্রা কম ছিল। চারদিকে ঠান্ডা আর কম তাপমাত্রার কারণে ভাইরাসের প্রকোপ খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিলো গত সপ্তাহ থেকে চিনে এই ভাইরাসের প্রকোপ কমতে শুরু করেছে। সেখানে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যাও কমেছে।
এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় করোনা ভাইরাস টিকে থাকতে পারে না। চিনে গবেষকরা বলেছে, প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে কোরোনার প্রকোপ কমার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ তাপমাত্রা যত বাড়বে ভাইরাসের বৃদ্ধি তত ঠেকানো সম্ভব। তবে শুধুমাত্র তাপমাত্রা বাড়িয়েই এই ভাইরাসের বিস্তার একেবারে বন্ধ করা সম্ভব নয়।
অন্যদিকে আবার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (এমআইটি) বিজ্ঞানীরা বলছেন, ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে কোরোনার সংক্রমণ যতটা দ্রুত হয়, তার উপরের তাপমাত্রায় একেবারে বন্ধ না হলেও সংক্রমণ অনেকখানি কমে।
এমআইটির বিজ্ঞানী ডাঃ কাসিম বুখারী জানান, যেখানে আবহাওয়া বেশি ঠান্ডা সেখানে কোভিড-১৯ ছড়ানোর হার অপেক্ষাকৃত দ্রুত। ইউরোপের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, বিশ্বের অন্যতম সেরা স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা থাকা সত্ত্বেও সেখানকার দেশগুলিতে কিভাবে দ্রুত ছড়িয়েছে করোনা। আমেরিকার ক্ষেত্রেও তাপমাত্রার হেরফেরেই সংক্রমণ মাত্রার হেরফের হয়েছে বলে জানান ডঃ বুখারী। তিনি বলেন, একই সময়ে আমেরিকার ওয়াশিংটন, নিউ ইয়র্ক, কলোরাডোর থেকে অ্যারিজোনা, ফ্লোরিডা, টেক্সাসে করোনা সংক্রমণ কম হয় উষ্ণতার পার্থকের জন্যই।
ঠিক একই দাবি করেছেন স্পেন ও ফিনল্যান্ডের একদল গবেষক। তাদের একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সবচেয়ে সক্রিয় থাকে করোনা ভাইরাস।
♦ভারতের উষ্ণ আবহাওয়া ও করোনার সম্প্রসারণঃ-
শীতপ্রধান ইউরোপীয় দেশগুলিতে (ইতালি, স্পেন, জার্মানি) যেখানে করোনা ভাইরাস তার হানা শক্ত করেছে, সেখানে ভারতে এই ভাইরাসের আগমন অপেক্ষাকৃত শীতকালের শেষের দিকে ঘটে। বিভিন্ন গবেষক ও বিজ্ঞানীদের মতামত অনুসারে অপেক্ষাকৃত বেশি উষ্ণতা যুক্ত স্থানে এই ভাইরাসের সম্প্রসারণ তুলনামূলক কম।
ভারতে এখন গরম পড়তে শুরু করেছে। তাই চীনের গবেষকদের রিপোটের ভিত্তিতে আশা করা যায় যে, গরম বাড়লে কোরোনার প্রভাব কমবে, এখন যেভাবে ছড়াচ্ছে ততটা ছড়াবে না। ভারতে মার্চ থেকে মে-জুন মাস পর্যন্ত ভালোই গরম থাকে, এই সময় ভারতের গড় তাপমাত্রা ৩২-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। ভারতের মধ্যে মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, অন্ধ্রপ্রদেশ, রাজস্থান, তামিলনাড়ু এই সমস্ত রাজ্যে তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর উপর থাকে। ভারতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যাক্তির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, কেরালা এই সমস্ত রাজ্যগুলিতে। উপরোক্ত গবেষকদের মতামত অনুযায়ী, গরম বাড়ার সাথে সাথে এই সমস্ত রাজ্যগুলিতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কমে যাওয়ার আশা আছে।
অবশেষে আমি এটুকুই বলতে চাই, যে এই করোনা মহামারীর উৎপত্তি যদি সত্যি সত্যি কোনো প্রাণীর থেকে ঘটে থাকে তাহলে, এই মহামারীর প্রকোপ থেকে অন্যান্য প্রাণীকুলও নিরাপদ নয়। তবে ইহা যদি সত্যি না হয় তাহলে কিভাবে এই বিশ্ব মহামারী জন্ম নিল? আশাকরি আগামী দিনে গবেষকরা তার সুনিশ্চিত উত্তর আমাদের কাছে তুলে ধরবেন।
লেখকঃ- সম্রাট পণ্ডিত (নবীনাবাগ, পশ্চিম মেদিনীপুর)
[লেখক রিসার্চ স্কলার, উইলিয়াম কেরি ইউনিভার্সিটি, শিলং]
তথ্যসূত্রঃ- (১) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (২) স্বাস্থ্য ও পরিবার মন্ত্রক, ভারত সরকার (৩) স্বাস্থ্য ও পরিবার মন্ত্রক, পশ্চিমবঙ্গ সরকার (৪) চীন : জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন (৫) ওয়ার্ল্ডমিটার (৬) অ্যাটমস্ফিয়ার, ওয়েদার ও ক্লাইমেট – কে. সিদ্ধার্থ (৭) ভারতের জলবায়ু – উইকিপিডিয়া (৮) দ্য ডন সংবাদপত্র (৯) বিবিসি নিউজ (১০) ইউনিসেফ ইন্ডিয়া
© মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া, ভূগোলিকা-Bhugolika, Geography & Environment, স্টুডেন্টস কেয়ার