বৃক্ষজননী সালুমারাদা থিম্মাক্কা : জননী তোমাকে প্রণাম
বৃক্ষজননী সালুমারাদা থিম্মাক্কা : জননী তোমাকে প্রণাম
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের রচনাতে, গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের সেই অমোঘ উক্তি — “সত্য সেলুকাস! কি বিচিত্র এই দেশ”। ভারতের একজন দরিদ্র, নিরক্ষর, দলিত নারীর প্রকৃতিপ্রেম ও পরিবেশ-মাতৃত্বে ‘বৃক্ষজননী’ হয়ে ওঠার এই বাস্তব কাহিনীতে আলেকজান্ডারের ওই উক্তি আবারও সার্থক। ভারতবর্ষই হল সেই বিচিত্র পু্ণ্যভূমি, যেখানে আপন কর্মযজ্ঞে এক প্রান্তিক কন্নড় নারীও হয়ে ওঠেন মহীয়সী, দেশের অনুপ্রেরণা। সত্যিই কি বিচিত্র এই ভারতভূমি!

‘সালুমারাদা থিম্মাক্কা’। দক্ষিন ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের টুমকুর জেলার গুব্বি তালুকের এক দরিদ্র দলিত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই কখনও স্কুলে যাওয়ার সুযোগ তাঁর হয়নি। ছোটবেলা থেকেই মাঠে শ্রমিকের কাজ করতেন। ২০ বছর বয়সে নিকটবর্তী হুলিকাল (মাগদি তালুক, রামনগর জেলা, কর্ণাটক) গ্রামের বেকাল চিক্কাইয়ার সাথে বিয়ে হয়। চিক্কাইয়া ছিলেন সহজ-সরল এক দিনমজুর। চিক্কাইয়ার কথা বলার সময় তোতলানোর সমস্যা ছিল। পরিবারে স্বচ্ছলতা ছিল না। কিন্তু চিক্কাইয়া ও থিম্মাক্কা পরস্পরকে অকুণ্ঠ ভালোবাসতেন। তাঁদের বিবাহিত জীবনের ২৫ বছর পরেও কোনো সন্তান হয়নি। এজন্য সমাজ তাঁদের একঘরে করে দিয়েছিল। ৪০ বছর বয়সে থিম্মাক্কা সন্তানহীনতার জন্য আত্মহত্যা করতেও চেয়েছিলেন। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন চিক্কাইয়া-থিম্মাক্কার দিনগুলো ছিল নিঃসঙ্গ, বিষণ্ণ। এরপরই তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, গাছ লাগানোর। সন্তানের মতো তাদের প্রতিপালন করার।

কিন্তু গাছের চারা কোথায় পাবেন? গাছের চারা কেনার টাকা তো নেই। ঠিক করলেন, পথের আনাচে-কানাচে জন্ম নেওয়া বটগাছের চারা সংগ্রহ করে লাগাবেন। কিন্তু গাছের চারা লাগাবেন কোথায়? তাঁদের তো নিজস্ব কোনো জমি নেই। ঠিক করলেন, কর্ণাটকের হুলিকাল ও কুদুরের মধ্যবর্তী সড়কের (হাইওয়ে, SH-৯৪) দুপাশে গাছের চারা লাগাবেন। শুরু হল কর্মযজ্ঞ। প্রথম বছরে ১০ টি। দ্বিতীয় বছরে ১৫ টি। তৃতীয় বছরে ২০ টি…। এভাবে শুরু হল বটগাছের চারা লাগানো। একসময় এই বৃক্ষ সন্তানদের দেখাশোনার জন্য চিক্কাইয়া দিনমজুরের কাজও ছেড়ে দেন। শুধু থিম্মাক্কা রোজগারের জন্য মাঠে শ্রমিকের কাজ করতেন এবং বাকিসময় স্বামীর সাথে বৃক্ষ সন্তানদের যত্ন নিতেন। রোজ প্রায় ৪ কিমি হেঁটে তাঁরা চারাগাছ গুলিতে জল দিতেন। গবাদি পশু থেকে চারাগাছ গুলিকে বাঁচাতে বেড়াও তৈরি করেন। এভাবে তাঁরা মোট ৩৮৫ টি বটগাছ লাগিয়ে বড়ো করে তোলেন। সমাজে একঘরে থিম্মাক্কার কাজের প্রতি সম্মান দেখিয়ে গ্রামবাসীরা তাঁকে ‘সালুমারাদা’ বলে ডাকতে শুরু করলেন। কন্নড় ভাষায় যার অর্থ ‘গাছেদের সারি’। এভাবেই তিনি হয়ে উঠলেন বৃক্ষজননী সালুমারাদা থিম্মাক্কা।

১৯৯১ সালে থিম্মাক্কার স্বামী চিক্কাইয়া মারা যান। তারপরও একাই লড়াই চালিয়ে যান থিম্মাক্কা। বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, শুধু ৩৮৫ টি বটগাছই নয়, গত ৮০ বছরে আরও প্রায় ৮০০০ গাছ পুঁতে তাদের বড় করে তুলেছেন বর্তমানে ১০৭ বছর বয়সী এই বৃক্ষজননী। CNN-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে থিম্মাক্কা জানান, “এটা আমার ভাগ্য যে আমার কোনো সন্তান নেই। এ কারণেই আমি আর আমার স্বামী মিলে গাছ লাগানোর এবং তাদের বড়ো করে তোলার সিদ্ধান্ত নিই। তাদেরকে আমাদের সন্তানের মতো করেই দেখাশোনা করতাম। তারাই আমাদের জীবনের আশীর্বাদ।” হয়তো এতো কিছু স্বত্ত্বেও সালুমারাদা থিম্মাক্কা লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে যেতেন। স্থানীয়দের মাধ্যমেই তাঁর কথা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৯৯৫ সালে ‘জাতীয় নাগরিক সম্মান’ ভূষিত হওয়ার পর তাঁর কথা জানতে পারে গোটা দেশ। স্বীকৃতি স্বরূপ একাধিক সম্মান ও পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি ; যথা — ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী বৃক্ষমিত্র পুরষ্কার (১৯৯৭), কর্ণাটক কল্পবল্লী পুরষ্কার (২০০০), হাম্পি বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা নাদোজা পুরষ্কার (২০১০) প্রভৃতি।

২০১৬ সালে বিবিসি-র বিচারে বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী মহিলাদের তালিকায় রয়েছে সালুমারাদা থিম্মাক্কার নামও। ২০১৯ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত করে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্ণিয়ার লস এঞ্জেলেস এবং ওকল্যান্ডে তাঁর নামানুসারে ‘Thimmakka’s Resources for Environmental Education’ একটি পরিবেশ সংস্থা গড়ে উঠেছে। ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ সালে কর্ণাটক সরকার ‘সালুমারদা থিমাক্কা ছায়া পরিকল্পনা’ তহবিল ঘোষণা করে। এই তহবিলের মাধ্যমে রাজ্যের নানা প্রান্তে, গাছ লাগানোকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সমাজ ও পরিবেশের প্রতি থিম্মাক্কার অসাধারণ কর্মোদ্যোগের কথা স্থান পেয়েছে ভারতীয় স্কুল-কলেজের পাঠ্যবই-তে। ১০৭ বছর বয়সেও তার বিশ্রাম নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। এখনও গাছ লাগিয়েই যাচ্ছেন এই নারী। থিম্মাক্কার গাছ লাগানোর এই নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা অনেককেই উদ্বুদ্ধ করেছে। তার এই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘সালুমারাদা থিম্মাক্কা ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন’। এটি একটি পরিবেশ সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান।

প্রকৃতির নিয়মে, ভবিষ্যতে একদিন থিম্মাক্কা এই পৃথিবীতে আর থাকবেন না। কিন্তু তাঁর সন্তানস্নেহে পালিত গাছগুলো বেঁচে থাকবে আরও কয়েকশো বছর, থিম্মাক্কার স্মৃতি ও ভালোবাসা নিয়ে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে থিম্মাক্কা এক অনুপ্রেরণার নাম। একজন সাধারণ মানুষ নিজ কর্মের সুবাদে এই সমাজ ও পৃথিবীতে যে অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পারেন, তার জ্বলন্ত উদাহরণ সালুমারাদা থিম্মাক্কা। এবছর রাষ্ট্রপতি ভবনে পদ্মশ্রী সম্মান গ্রহণের সময় তিনি প্রোটোকল ভেঙে অনায়াস ভঙ্গিতে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন এবং বলেন – “Ee Deshakke Devaru Valleyadu Madali” অর্থাৎ ‘ঈশ্বর এই দেশকে আশীর্বাদ করুন’। তাই একেবারে পরিশেষে এই মহান নারীর উদ্দেশ্যে বলতে চাই – “বৃক্ষজননী সালুমারাদা থিম্মাক্কা, জননী তোমাকে প্রণাম” ।
লেখকঃ- অরিজিৎ সিংহ মহাপাত্র, ভূগোলিকা-Bhugolika & মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া (পার্শ্বলা, বাঁকুড়া)।
প্রথম প্রকাশঃ ভূগোলিকা ফেসবুক পেজ, দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি-৩০/০৩/২০১৯
তথ্যসূত্রঃ- Wikipedia ; আনন্দবাজার পত্রিকা ; The New Indian Express ; Roar Media Bangla ; BBC ; Deccan Herald ; Saalumarada Thimmakka International Foundation ; Times of India ; India Today
©Mission Geography India
©ভূগোলিকা-Bhugolika