রহস্যময় আমাজন অরণ্য

রহস্যময় আমাজন অরণ্য

আমাজন বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তম আশ্চর্যের একটি। আমাজন অরণ্য দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীর অববাহিকায় অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিরক্ষীয় অরণ্য। পৃথিবীর অনেক রহস্য আজও আমাদের অজানা, এমনই এক রহস্য হল আমাজন অরণ্য। আমাজনের অরণ্য অত্যন্ত দুর্গম। এই নিরক্ষীয় অরণ্যের প্রাকৃতিক বিস্ময় মানুষকে অবাক করে। রহস্যের জমকালো অন্ধকারে আবৃত বৃষ্টিঅরণ্য আমাজন মানেই, মনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা শিহরণ ও অনুসন্ধিৎসার জেগে ওঠা! সৌন্দর্য ও আতঙ্কের যোগফল হল পৃথিবীর বৃহত্তম নিরক্ষীয় অরণ্যটি।

দক্ষিণ আমেরিকায় অবস্থিত আমাজন নদী মোট ৭০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার অববাহিকা পরিবেষ্ঠিত। প্রায় ৫৫ লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত এই বনভূমি ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ নামে পরিচিত।আমাজনের বয়স ৩০০০ বছর প্রায়। আমাজন নদী বিধৌত অঞ্চলে অবস্থিত এই বৃষ্টিঅরণ্য দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ৯ টি দেশ জুড়ে বিস্তৃত। যার ৬০ ভাগ ব্রাজিলে, ১৩ ভাগ পেরুতে এবং বাকি অংশ কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম ও ফ্রেঞ্চ গায়ানাতে অবস্থিত।ভাবলে বিস্ময়ে শিহরণ জাগে যে, সমগ্র বিশ্ব জুড়ে বৃষ্টিঅরণ্যের যা ব্যাপ্তি, তার অর্ধেকটা স্থান রাজকীয় মর্যাদায় দখল করে আছে এই অরণ্য নিজেই।

এই বৃষ্টিঅরণ্যের আমাজন নামটি ফ্রান্সিসকো ডি ওরেলামা কর্তৃক দেওয়া। বলা হয়ে থাকে, ফ্রান্সিসকো ডি ওরেলামা তপুয়াস এবং অন্যান্য উপজাতির সাথে লড়াই করেছিলেন। গোষ্ঠীর মহিলারা তাদের রীতি অনুসারে পুরুষদের সাথে লড়াই করেছিলেন। ‘ওরেলানা হেরোডোটাস’ এবং ‘ডায়োডরাস’ দ্বারা বর্ণিত ‘অ্যামাজনস অফ গ্রীক পুরাণ’ থেকে ‘অ্যামাজনাস’ নামটি এসেছে। পর্তুগিজ অভিযাত্রীরা বিশ্বাস করত, বিশাল এ অরণ্যের মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছে ‘এল ডোরাডো’ নামক এক গুপ্তশহর, যা পুরোপুরি সোনার তৈরি। এই ভ্রান্ত ধারণাটি এসেছে গ্রিক পৌরাণিক গল্প থেকে, যেখানে বলা হয়েছে যে ‘এল ডোরাডো’ নামক সোনায় মোড়ানো শহরটি পাহারা দেয় এক শ্রেণীর বিশেষ নারী যোদ্ধারা, যাদেরকে গল্পে ‘আমাজন’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। পর্তুগিজ, স্প্যানিশ এবং ফ্রেঞ্চ অভিযাত্রীরা প্রতিযোগিতায় নামে এই ‘এল ডোরাডো’ শহর আবিষ্কারের জন্য। কিন্তু কেউ এই কাল্পনিক শহরের খোঁজ পায়নি। শহরের সন্ধান না পেলেও স্থায়ী হয়ে যায় সেই নারী যোদ্ধাদের নাম। তাদের নামানুসারেই এই অরণ্যের নাম হয় ‘আমাজন’ অরণ্য।

রহস্যময় আমাজন অরণ্য সবার রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু। আমাজন অরণ্যের মধ্যে আছে একটা ফুটন্ত নদী। এই অরণ্যের রহস্য জানার জন্য বহু মানুষ ছুটে যান আমাজন অরণ্যে। এই অরণ্যকে জানার জন্য অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। আমাজন নদীর নিচে একটি নদীর সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। যার নাম হামজা। ভয়ানক আমাজন অরণ্যে রয়েছে আদিবাসীদের বসবাস। স্প্যানিশ পর্যটক ফ্রান্সিস ওরে লালা প্রথম মানুষ যিনি আমাজন নদী ধরে পৌঁছে যান পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বৃষ্টিঅরণ্য আমাজনে। ছোট পোকামাকড় আর রংবেরঙের পাখিতে সমৃদ্ধ এই অরণ্যের প্রাণী ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য গবেষকদের বিস্মিত করে।এখনও আমাজনের বহু গহীন স্থানে মানুষের পা পড়েনি। সোনার শহরের খোঁজে শত শত বছর ধরে এই বনে ছুটে এসেছেন অভিযাত্রীরা। আমাজনের রহস্যময় ফুটন্ত নদীর জলের তাপমাত্রা প্রায় ৮৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এর জল এত গরম যে তাতে পড়ে গেলে মানুষ মারা যেতে পারে। এই নদীতে সাঁতার কাটা যায় না। সকলের কাছে এটি ‘রহস্যময় মৃত্যুফাঁদ নদী’ নামে পরিচিত। আমাজনের অ্যানাকোন্ডা নিয়ে আছে নানা রকমের মিথ। মানুষ গিলে ফেলা সাপের কথা উঠলেই দৈত্যাকার অ্যানাকোন্ডার দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠে। কিন্তু বাস্তবে মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করে এই দৈত্যাকার সাপ।

কেভারনা দা পেদ্রা পিন্টাদায় খননকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে, কমপক্ষে ১১,২০০ বছর আগে মানব বাসিন্দারা প্রথমে অামাজন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তী বিকাশ লক্ষ্য করা যায় ১২৫০ খ্রিস্টাব্দে অরণ্যের পরিধি বরাবর। দীর্ঘদিন ধরে এটি মনে করা হয়েছিল যে অামাজন বৃষ্টিঅরণ্য কখনও কম জনবহুলের চেয়ে বেশি ছিল না। কারণ অনুর্বর জমি দিয়ে কৃষিক্ষেত্রের মাধ্যমে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী বজায় রাখা অসম্ভব ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক বেটি মেগার্স এই ধারণাটির বিশিষ্ট প্রবক্তা ছিলেন, যেমনটি তাঁর বই ‘অ্যামেজোনিয়া: ম্যান অ্যান্ড কালচার ইন কাউন্টার নাইট প্যারাডাইজে’ বর্ণিত হয়েছে, তিনি দাবি করেছিলেন যে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ০.২ জনসংখ্যার ঘনত্বটি হল সর্বাধিক যা শিকারের মাধ্যমে বৃষ্টিপাতের মধ্যে টিকে থাকতে পারে, যেখানে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আয়ের জন্য কৃষিক্ষেত্র প্রয়োজন। যাইহোক, সাম্প্রতিক নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধানগুলি প্রমাণ করেছে যে অঞ্চলটি আসলে ঘনবসতিপূর্ণ ছিল। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষ অামাজন অঞ্চলে বসবাস করতে পেরেছিলেন। ১৯০০ সালের মধ্যে জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল ১ মিলিয়নে এবং ১৯৮০ এর দশকের প্রথমদিকে তা ২০০,০০০ এরও কম ছিল। এই আমাজন অরণ্যের মধ্যে রয়েছে এক নিষিদ্ধ রহস্যময় স্থান। রহস্যময় আমাজনের জঙ্গলে এমন সব জায়গা আছে সেখানে কি থাকতে পারে তা কল্পনার অতীত। সেরকমই একটা জায়গা হল ‘ভ্যাল ডো জাভারি রিজার্ভেশন’। নাম শুনলেই বোঝা যায় এটি একটি সংরক্ষিত এলাকা। এখানে এলে দেখতে পাওয়া যায় স্থানীয় আদিবাসীদের গ্রাম। যাদের বাইরের পৃথিবীর সাথে কোন যোগাযোগ নেই। বাইরের পৃথিবী নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তারা এখনও সেই প্রাচীন যুগের মানুষ হয়েই আছে। চিন্তা-চেতনা, সংস্কৃতি, আচার-বিচার সহ সবকিছু নিয়ে তারা এখনও ঠিক প্রাচীন পৃথিবীতেই আজকে রয়েছে। তাদের এলাকাটি রয়েছে আমাজনের ব্রাজিল অংশে। আকাশ থেকে চালানো সার্ভেতে দেখা যায় প্রায় ১৪ টি গ্রাম রয়েছে। যারা জীবনযাপনের জন্য সম্পূর্ণরূপে কৃষি এবং আমাজন জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল। তাদের জীবনযাপন ও সংস্কৃতি বাইরে প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে ব্রাজিল কর্তৃপক্ষ এই বিশাল এলাকাটি সংরক্ষিত এলাকা বলে ঘোষণা করেছে। এখানে বাইরের সভ্য জগতের মানুষের প্রবেশ নিষেধ।

আমাজনকে ‘রেইনফরেস্ট’ অর্থাৎ বৃষ্টিঅরণ্য বলা হলেও এর অর্থ কিন্তু এই নয় যে, এখানে সারা বছর বৃষ্টিপাত হয়। বরং রেইনফরেস্ট বলা হয় এখানকার অত্যধিক আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত (বর্ষা মরসুমে) এবং গরম আবহাওয়ার কারণে। প্রচণ্ড গরম এখানে আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ। এই গরম আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত এবং আর্দ্রতার কারণে এ অরণ্যে উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের বৈচিত্রময় সমাহার। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই অরণঢ। এই অরণ্যে ৩৯০ বিলিয়ন বৃক্ষ রয়েছে, যা ১৬,০০০ প্রজাতিতে বিভক্ত৷ এছাড়া ১২৯৪ প্রজাতির পাখি, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২৮ প্রজাতির উভচর এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীসহ রয়েছে আরো হাজারো প্রজাতির নাম না জানা জীব। এখানে আছে ১২০ ফুট উঁচু গাছ, ৪০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, ২.৫ মিলিয়ন প্রজাতির কীট-পতঙ্গ, হাজারো প্রজাতির অজানা জীব-অণুজীব।

এখানকার প্রাণীবৈচিত্র অতুলনীয়। অ্যানাকোন্ডা, জাগুয়ার, আমাজন রিভার ডলফিন, হার্পি ঈগল, ম্যাকাও, পিরানহা, ইলেকট্রিক ঈল সহ নাম না জানা হাজারো প্রজাতির জীব-অনুজীবের বাস এই অরণ্যে। মজার বিষয় হলো হাজারো রকমের প্রাণীর সমাহার থাকলেও এখানকার বাস্তুতন্ত্র অত্যন্ত শক্তিশালী যা মিলিয়ন বছর ধরে টিকে আছে। এই অরণ্যের স্তন্যপায়ীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – জাগুয়ার, গোলাপি ডলফিন, তামানডুয়া, তাপির, মানাতি, ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, বাদুড় ইত্যাদি। পাখিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ঈগল, টুকান, হোয়াটজিন, দ্রুতগামী হামিং বার্ড এবং আরও রঙ-বেরঙের অনেক পাখি।পৃথিবীর সকল পাখির এক পঞ্চমাংশ পাখি এই অরণ্যের অধিবাসী। মাছের মধ্যে আছে মাংসাশী লাল পিরানহা, বিপদজনক বৈদ্যুতিক মাছ এবং স্বাদু জলের অন্যতম বড় মাছ – পিরারুকু, যার ওজন ১৫০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। উভচর প্রাণীর মধ্যে লাল চোখ বিশিষ্ট গেছো ব্যাঙের নাম না বললেই নয়। সরীসৃপের মধ্যে আছে বিখ্যাত সাপ ‘বোয়া’, যা তার শিকারকে পেঁচিয়ে ধরে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে। তাছাড়া রয়েছে কুমীর, অ্যালিগেটর, কচ্ছপ প্রভৃতি। এছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির পিঁপড়া, বড় তলাপোকা, রঙ-বেরঙের প্রজাপতি, শুঁয়োপোকা আর জানা অজানা হরেক রকমের পোকা-মাকড়ের বসতি এই আমাজনে।

আমাজন পৃথিবীর আকর্ষণীয় জায়গার সাথে বিপদজনকও বটে। এখানে অনেক বিপদজনক প্রাণী রয়েছে, তারা মানুষকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেরে ফেলতে পারে।
★ এই অরণ্যের জলাভূমিতে বসবাস করা ২০-৪০ ফুটের ভিন্ন প্রজাতির অ্যানাকোন্ডার মধ্যে গ্রীন অ্যানাকোন্ডা, বিষহীন হলেও শিকারকে পেঁচিয়ে, দুর্বল করে আস্ত গিলে ফেলে।
★ ১৩-২০ ফুটের ব্ল্যাক কেইম্যান (কুমীর), ভয়ঙ্কর বিপদজনক প্রাণী হিসাবে বিবেচিত হয়।
★ সবচেয়ে শক্তিশালী পাখি হার্পি ঈগল, যারা অত্যন্ত সাহসী ও শিকারী।
★ বিশ্বের অন্যতম বিষাক্ত উভচর প্রাণী পয়জন ডার্ট ফ্রগ। এই ব্যাঙ এতটাই বিষাক্ত যে, এদের একটা কামড়, সরাসরি হৃদপিন্ড ও মস্তিষ্কে আঘাত করে এবং এক সাথে ১০ জনকে মেরে ফেলার ক্ষমতা ধারণ করে।
★ গাছে বসবাসকারী এক থেকে দেড় ইঞ্চির বেশি লম্বা, ভয়াবহ বুলেট অ্যান্ট, এই পিঁপড়ের একটি কামড়, একটি মৌমাছির হুল ফোটানোর থেকে ৩০ গুণ বেশি যন্ত্রণাদায়ক ও সর্বোপরি একটি বুলেটের আঘাতের মতন লাগে বলে এমন নামকরণ হয়। পেরুর আমাজন অরণ্যের একটিমাত্র গাছে ৪৩ প্রজাতির পিঁপড়ার সন্ধান পাওয়া গেছে।
★ দেড় মিটার লম্বা মারাত্মক বিষাক্ত র‍্যাটেল স্নেক। এ ধরনের বিষক্রিয়ায় শরীরের টিস্যু ধ্বংস হয়, বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং কোয়াগুলোপ্যাথি বা রক্ত জমাট ব্যাহত হতে দেখা দেয়। বিষাক্ত দংশনের ক্ষেত্রে ক্ষত যদি খুব মারাত্মক হয় ও এনভেনোমেশন অর্থাৎ দংশন পরবর্তী শরীরে বিষের উপস্থিতি যদি খুব বেশি হয় তবে অতিসত্বর, কার্যকর চিকিৎসা দেওয়া সত্ত্বেও দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে বা মৃত্যু ঘটতে পারে।
★ ওয়ান্ডারিং স্পাইডার – বিষাক্ত ও আক্রমণাত্মক স্বভাবের জন্যে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে এদের নাম নথিভুক্ত হয়েছে।
★ ইলেকট্রিক ঈল মাছ অনেকেরই আজ পরিচিত একটি জলজ প্রাণী। আমাজন নদীর নিচের দিকে অস্বচ্ছ জলে থাকা ৬-৮ ফুট লম্বা এই প্রজাতির মাছ ৬০০ ভোল্টের বৈদ্যুতিক শক দিতে সক্ষম, যা স্তন্যপায়ী বা অমেরুদণ্ডী যে কোনো ধরণের প্রাণীর শিকারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিপজ্জনক!
★ স্থলজ ও জলজ হিংস্র প্রাণীদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণভাবে উঠে আসে আরো যে সমস্ত নাম তার মধ্যে, এক বিশিষ্ট প্রজাতির বৃহৎ বিড়াল জাগুয়ার (৮৫-৯০ রকমের ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর বিশেষত শিকারের ক্ষেত্রে এরা মারাত্মক আক্রমণাত্মক!), পিরানহা (তীক্ষ্ণ ধারালো দাঁতবিশিষ্ট রাক্ষুসে মাছ) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

৩৫০-এর বেশি বৃহৎ সম্প্রদায়ের উপজাতির আবাসস্থল এই বনভূমি। এছাড়াও এখানে বাস করে প্রচুর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, যার সংখ্যাটা ১০ লাখেরও বেশি এবং এদের বেশির ভাগই ব্রাজিলীয়।এদের কিছুজনের আজ অবধি কোনো সম্পর্কই নেই বহিঃবিশ্বের সাথে। আমাজন অরণ্যের জীবনীশক্তি হল আমাজন নদী। প্রায় ১১০০ টিরও বেশি ছোটোবড়ো উপনদী নিয়ে আমাজন নদী গঠিত যার মধ্যে ১৭টি নদীর দৈর্ঘ্য ১০০০ মাইলেরও বেশি।বৈচিত্রময় উদ্ভিদ প্রজাতির বাসস্থান হিসেবে সমৃদ্ধ এই আমাজনে বিশ্বের শতকরা ২৫ ভাগ ফার্মাসিটিক্যাল ঔষধের গাছ আসে এই আমাজন অরণ্য থেকে। এই অরণ্যে যত গাছ বিজ্ঞানীরা ঔষধের জন্য পরীক্ষা করেছেন তার পরিমান মোট পরিমাণের মাত্র ১%, বাকী ৯৯% গাছই এখনও পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। কে জানে, সেই বাকি ৯৯% গাছে হয়তো রয়ে গেছে বিভিন্ন নতুন কোনো রোগের চিকিৎসা। সারা পৃথিবীর লোকজন যেখানে মাত্র ২০০ জাতের ফল ভোগ করে সেখানে আমাজনের বাসিন্দারা ২০০০ জাতের বিভিন্ন ফল উপভোগ করেন। ধান, গম, আনারস, টমেটো, আলু, কলা, গোলমরিচ, কফি ও কোকোয়াবীজ-সহ বিভিন্ন খাদ্যের উৎস এই সুবিশাল বনভূমি। রেইন ফরেস্ট আমাজনে মাত্র দুটি ঋতু রয়েছে। গ্রীষ্ম ও বর্ষা। অত্যন্ত উষ্ণ এই অরণ্যের বৃক্ষের পাতাগুলি বড় ও শক্ত এবং গাছগুলি এতটাই সন্নিবিষ্টভাবে জন্মায় যে বনের তলদেশে সূর্যের আলো পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারে না, তাই এই অরণ্যের তলদেশ আর্দ্র প্রকৃতির। ১২০ ফুট পর্যন্ত বৃক্ষের দেখা মেলে এই রহস্যময় জঙ্গলে।

আমাদের ধারণার চেয়েও দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে আমাজনের জীববৈচিত্র্য। প্রতি সেকেন্ডে সেখানকার ১.৫ একর জমির অরণ্য ও প্রতিদিন গড়ে ১৩৭ প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে। আমাজনে অন্তত ৫০টি গোত্রের ২১ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করেন। আধুনিক সভ্যতার সাথে কোন যোগাযোগ নেই তাদের। গাছপালা ও পাতায় আবৃত থাকায় আমাজন অরণ্যের তলদেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। সেখানে সূর্যের আলোর মাত্র ১% পৌঁছায়। এছাড়া বৃষ্টির জল জঙ্গলের মাটি পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় নেয় প্রায় ১০ মিনিট, ক্যানোপি সৃষ্টি হবার জন্য। যদি এই অরণ্যটি একটি দেশ হত, তাহলে বিশালতার দিক থেকে বিশ্বের নবম বড় দেশ হত। ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডকে ১৭ বার এই অরণ্যে রাখার মত জায়গা আছে।

চরম বিপদসংকুল আমাজন অরণ্য ও অরণ্য অধ্যূষিত অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষজনকে এইসব কারণেই প্রতিমুহূর্তে কঠিন সংগ্রাম করতে হয় বেঁচে থাকার জন্যে। অথচ অপরিকল্পিতভাবে, প্রয়োজনের স্বার্থ চরিতার্থ করার একান্ত উদ্দেশ্যে অবিশ্বাস্য মাত্রায় হত্যা করা হচ্ছে এই সমস্ত বিভিন্ন প্রকৃতির বৃক্ষ ও প্রাণীসম্পদ।বলাবাহুল্য সমগ্র পৃথিবীর ২০% অক্সিজেন আসে এই আমাজন থেকেই জানতাম। কিন্তু আমাজনের অক্সিজেনের এক ফোঁটাও আমাজনের বাইরে আসে না। প্রতি বছর আমাজনের রেইনফরেস্ট পৃথিবীর সমস্ত মানুষের মোট প্রয়োজনের কুড়ি গুণ অক্সিজেন তৈরি করে। তার পুরোটাই লাগে আমাজনের মধ্যে বসবাসকারী বাস্তুতন্ত্রের প্রয়োজন মেটাতে। আমাজন তার মানে অক্সিজেন দেয় না মানুষকে? সহজ উত্তর — সরাসরি না। এ এক অদ্ভুত গ্লোবাল প্রসেস। কি হয় পুরো ব্যাপারটা? শুনলে মনে হবে থ্রিলার। সেই থ্রিলার শুরু হয় উত্তর আফ্রিকার মরুভূমিতে। ধুলোর ঝড়। গরম বাতাসে মিশে থাকা ধুলোর কণা। আস্তে আস্তে আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে সেই ধুলোর আস্তরণ গিয়ে পড়ে আমাজন অববাহিকায়। নিয়ে যায় গাছপালা আর বাকি বাস্তুতন্ত্রের বেঁচে থাকার মহামূল্যবান পরিপোষক। গড়ে ত্রিশ মিলিয়ন টন ধুলো আফ্রিকা থেকে গিয়ে জমা হয় আমাজনে প্রতি বছর। গাছ মাটি থেকে জল টানে। অভিকর্ষ অতিক্রম করে সেই জল বাষ্প হয়। হাজার হাজার বর্গমাইলব্যাপী বাষ্পের এক নদী। যেটা নীচের আমাজন নদীটার থেকে অনেক অনেক বড়। সেই বাষ্পের নদী গোটা দক্ষিণ আমেরিকা পেরিয়ে গিয়ে ধাক্কা খায় আন্দিজ পর্বতে। আনে বৃষ্টি। আন্দিজের গা বেয়ে সেই বৃষ্টির জল বয়ে আসে আমাজন অববাহিকায়। ধুয়ে নিয়ে যায় পাথর। সাথে মিশে থাকে খনিজ। জরুরী পুষ্টি। আমাজন মেশে সমুদ্রে। সেখানে সেই পুষ্টির অপেক্ষায় থাকে এক অসামান্য জিনিস, ডায়াটম। সমুদ্রে থাকা এই ডায়াটম হল পৃথিবীর অক্সিজেনের অন্যতম প্রধান সোর্স। নদীর জলে ভেসে আসা সিলিকা ব্যবহার করে এই ডায়াটম। তৈরি করে নতুন কোষ। একপ্রকার প্রজনন। প্রতিদিন এদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়। ডায়াটম সালোকসংশ্লেষ করতে পারে। সেই থেকে আসে আমাদের অক্সিজেন। আমাদের সমস্ত প্রয়োজনের ৫০% অক্সিজেন। আফ্রিকান ধুলিঝড় না থাকলে হারিয়ে যাবে আমাজন। আমাজন না থাকলে বাঁচবে না ডায়াটম। ডায়াটম না থাকলে অক্সিজেন উৎস কমে যাবে এক ধাক্কায় অর্ধেক। আমাজন অরণ্য টিকে থাকার জন্য অনেকটা নির্ভর করে সাহারা মরুভূমির উপর। নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, সাহারা মরুভূমির বালি ও ফসফরাস আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে জমা হয় আমাজন অরণ্যে আর এর মাধ্যমে জীববৈচিত্র টিকে থাকে আমাজন অরণ্যে।

আমাজন অরণ্যের ব্রাজিল সীমানার ভিতরে থাকা অংশে কিছু এলাকায়, স্থানীয় নৃতাত্বিক গোষ্ঠীর মালিকানাধীন জমিতে অবৈধ কার্যক্রম বেড়েছে বিপদজনক হারে, হাজার হাজার অবৈধ সোনার খনি খননে আমাজন বন উজাড় হচ্ছে। চিরহরিৎ এই বনাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে চারশোর বেশি অবৈধ সোনার খনি খনন করা হয়েছে। দ্রুত সাবাড় হচ্ছে অরণ্য, আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। দূষিত হয়ে যাচ্ছে বনের নদীগুলো।বনভূমি এখন গৃহপালিত পশুর চারণভূমিতে পরিণত হচ্ছে। ট্যাপাজোস নদীর জল কমলা বর্ণের হয়ে গেছে দূষণের ফলে। সরকার ও বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের আঞ্চলিক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। অবৈধ উপায়ে নজিরবিহীনভাবে সোনার খনির খোঁজ করাই অ্যামাজনে আগুন লাগার পেছনে দায়ী এবং এসব খনি থেকে স্বর্ণ উত্তোলনের লোভেও এর বাণিজ্য বিস্তারে আমাজনকে ঘিরে বেড়ে উঠেছে বহু সভ্য জনপদ। আঞ্চলিক প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে রাস্তা নির্মাণ, রেলপথ স্থাপন, বন্দর ও নৌপথ নির্মাণ। গভীর জঙ্গল এলাকায় মূল্যবান খনিজ, তেল, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস সহ অন্যান্য সম্পদ উত্তোলন করা। যথেচ্ছভাবে উত্তোলন করা হচ্ছে এই সকল সম্পদ।

এভাবেই দিনে দিনে অবৈধ খনি বাণিজ্যের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে আমাজনের গহীন অরণ্য। সরকারও হাত মিলিয়েছে এসবের সাথে। যার ফল স্বরূপ আমরা দেখতে পাই আমাজন জঙ্গলের ভয়াবহ দাবানল। ১৯৯০ সালের মধ্যে ৪ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বনভূমি ধ্বংস করা হয়। ২০০০ সালে যার পরিমাণ এসে দাঁড়ায় ৫ লক্ষ ৮৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার। এগুলো হল অপরিকল্পিত অরণ্য নিধন। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছে যে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যেতে পারে আমাজনের অরণ্য। দেখা যায় ইউরোপীয়দের আগমনের পর থেকেই আমাজনের জীববৈচিত্র ব্যাহত হতে থাকে।১৯৭০ সালে শুরু হয় ট্রান্স অ্যামাজনিয়ান হাই ওয়ে নির্মাণের কাজ। যা ছিল এই রেইন ফরেস্টের জন্য হুমকি স্বরূপ। তবে সৌভাগ্যবশত হাইওয়ের কাজ সম্পূর্ণ হয়নি তার ফলে আমাজন কিছুটা হলেও কম দূষণের শিকার হয়েছিল। আমাজন বিশ্বের বৃহত্তম বৃষ্টি অরণ্য, যা প্রচুর কার্বন শুষে নেয় সে কারণে বায়ুর তাপমাত্রা কমিয়ে রাখতেও সাহায্য করে। কার্বন শুষে নিয়ে অক্সিজেন ছাড়ার কারণে এই অরণ্যটি পরিচিত পৃথিবীর ফুসফুস নামে। দাবানলের কারণে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড নিঃসৃত হয়, যা ব্রাজিলের জন্য ও আশেপাশের দেশগুলোর জন্য ক্ষতিকারক। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আমাজন অরণ্যের ভয়াবহ দাবানলের পিছনে কয়েকটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন যথার্থভাবেই — প্রথমত, বিভিন্ন কারণে বৃক্ষচ্ছেদন করে বনভূমিকে উজাড় করা, মনুষ্য প্রজাতির বসতি স্থাপন-সহ বিভিন্ন নির্মাণের উদ্দেশ্যে মানুষ নির্বিচারে ও নির্দ্বিধায় সেখানকার চিরহরিৎ বৃক্ষের ঘন অরণ্যভূমিকে ধ্বংস করে পুড়িয়ে দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, প্রাচীন স্থানান্তর কৃষি পদ্ধতি এবং বর্তমানে আধুনিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা। তৃতীয়ত, সাম্প্রতিক সময়ে বনভূমি উজাড়, অপরিকল্পিত মানববসতি স্থাপন দাবানলসহ বহুবিধ কারণে পৃথিবীর এই ফুসফুস ক্ষয় হয়ে চলেছে।

এর থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়, নিজেদের স্বার্থেই পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে এই বনভূমি রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে – পৃথিবীর ফুসফুস যতক্ষণ সচল থাকবে, মানবসমাজও ততদিন টিকে থাকবে। অরণ্য এভাবে পুড়ে ছারখার হয়ে গেলে সঙ্কটে পড়বে পৃথিবীর জলবায়ু। সঙ্কটে পড়বে মানবসভ্যতাও।


লেখিকাঃ- অনিন্দিতা চৌধুরী (শ্যামনগর, উত্তর ২৪ পরগণা)
[লেখিকা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল স্নাতকোত্তর বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী]
তথ্যসূত্রঃ- উইকিপিডিয়া ; আনন্দবাজার পত্রিকা ; এই সময় ; ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল

প্রথম প্রকাশঃ- ভূগোলিকা ফেসবুক পেজ, চতুর্থ বর্ষপূর্তি-৩০/০৩/২০২১

©ভূগোলিকা-Bhugolika
©মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত