ইতিহাস ও ভৌগোলিক নিদর্শনের এক ক্ষেত্র ‘গড় পঞ্চকোট’

“মেঘনাদবধ” স্রষ্টা তার ‘পুরুলিয়া’ শীর্ষক সনেটে লিখেছেন —
“পাষাণময় যে দেশ, সে দেশে পড়িলে
বীজকুল, শস্য তথা কখন কি ফলে?
কিন্তু কত মনানন্দ তুমি মোরে দিলে,
হে পুরুল্যে !”

পুরুলিয়া যা অতীতে পরিচিত ছিল ‘মানভূম’ নামে এবং ব্রিটিশ শাসনকালে তার নাম হয় ‘জঙ্গলমহল’। এই জেলাটির কথা শুনলেই চোখের সামনে চট করে উঠে আসে ‘রুখা-শুখা’র কথা। খরা, স্বল্প বৃষ্টিপাত, প্রস্তরময় ভূপ্রকৃতি এই জেলার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এই জেলারই আরেকটি অন্য রূপ হল আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক সুবিশাল মনোরম ভান্ডার। এখানে কান পাতলেই শোনা যায় ধামসা মাদলের আওয়াজ আর তার সঙ্গী ঝুমুর, ভাদু, টুসু থেকে ‘পিন্দারে পলাশের বন’। ছৌ নাচ এই জেলার মণিহার, যা এই জেলাকে বিশ্বের দরবারে খ্যাতি এনে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের এই জেলা যেমন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে তেমনি ভৌগোলিক নিদর্শনেও জুড়ি মেলা ভার। এককথায়, পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম ভৌগোলিক সমৃদ্ধ জেলা হল এই পুরুলিয়া। কত যে চোখধাঁধানো ভৌগোলিক স্থান আছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

গড় পঞ্চকোট
চিত্রঃ- পাঞ্চেত জলাধার এবং গড় পঞ্চকোট

আজ আমার কলমে তারই একটি ভৌগোলিক নিদর্শন তুলে ধরলাম, যার নাম ‘গড় পঞ্চকোট’ (Garh Panchakot)
‘গড়’ কথাটির সঙ্গে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত, যার অর্থ — ‘দুর্গ’। আর ‘পঞ্চকোট’ শব্দটির অর্থ ‘পঞ্চ’ মানে ‘পাঁচ’ এবং ‘কোট’ যার অর্থ ‘গোষ্ঠী’, অর্থাৎ পাঁচটি আদিবাসী গোষ্ঠী, যার থেকে এই পঞ্চকোট নামের উদ্ভব। আর অতীতে পঞ্চকোট রাজাদের (৯২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) এইখানে একটি গড় বা দুর্গ ছিল। সেখান থেকেই এর নামকরণ হয় ‘গড় পঞ্চকোট’। পঞ্চকোট পাহাড় আর মন্দির ও স্থাপত্যের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে এই গড় পঞ্চকোট। এটি ভারতের পূর্ব দিকে ছোটনাগপুর মালভূমির পূর্ব প্রান্তে পুরুলিয়ার উত্তর-পূর্বে নিতুরিয়া ব্লকের অন্তর্গত গড় পঞ্চকোট মৌজার সমগ্র অংশ এবং পাহাড়গড়া, রামপুর, লালপুর ও পুয়াপুর মৌজার কিছুটা অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে।

গড় পঞ্চকোট
চিত্রঃ- পঞ্চকোট পাহাড়

পঞ্চকোট পাহাড়ের উচ্চতা হল ৪৯০ মিটার বা ১৬১০ ফুট। পঞ্চকোট পাহাড়ের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ হল — ৮৬°৪৭’ পূর্ব এবং ২৩°৩৭’ উত্তর এবং গড় পঞ্চকোটের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ হল:- ৮৬.৭৬৬৬৭° পূর্ব ও ২৩.৬° উত্তর। বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক H. Coupland তাঁর গ্রন্থ Bengal District Gazetteers- Manbhum’-তে এই জায়গাটি সম্পর্কে বলেছেন — ‘পঞ্চকোট বা পাঞ্চেত (১৬০০ ফুট) জেলার উত্তর-পূর্বে পুরুলিয়ার প্রায় ৩৫ মাইল উত্তরে সর্বাধিক স্পষ্টতম বস্তু। আকারে এটি একটি দীর্ঘ অর্ধচন্দ্র যা পূর্বের সীমানায় সর্বোচ্চ পয়েন্টে উঠেছে। এটি ছোট তবে ঘন জঙ্গলে আচ্ছাদিত, এর গোড়ায় নীচু পাদদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিছু আম ও মহুয়া। পূর্ব মুখের পাদদেশে পাঞ্চেত রাজাদের পুরাতন প্রাসাদ এবং দুর্গের ধ্বংসাবশেষ এবং এর উপরে এবং নীচে কিছু প্রাচীন মন্দির রয়েছে।’ কোথাও উঁচু কোথাও আবার নিচু আর তারই মাঝে পলাশ, শাল, সেগুন, মহুয়া, শিরীষ প্রভৃতি নানা গাছের সমাহার। একদিকে পাঞ্চেত জলাধার অন্যদিকে পঞ্চকোট পাহাড় সমগ্র অঞ্চলটি মনমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এই গড় পঞ্চকোট বাংলায় বর্গী আক্রমণের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। পূর্বে পঞ্চকোট রাজাদের রাজত্বকালে এখানে পরিখার সংখ্যা ছিল পাঁচটি, ১১০ টি ছোট-বড় পুকুর, এবং দক্ষিণ পশ্চিম দিকে বাঁশ ও কাঁটা জঙ্গল দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল এবং তারই মাঝখানে একটা পরিখ‍া ছিল। এখানে রয়েছে সপ্তদশ শতাব্দীর রঘুনাথ জিউর মন্দির, কঙ্কালী মাতার মন্দির, রাস মন্দির, পঞ্চরত্ন মন্দির, রানী মহলের ধ্বংসাবশেষ, জোড় বাঁধ, সায়ের, রাজপ্রাসাদের স্মৃতিচিহ্ন, এছাড়াও অনেক মন্দির ও স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ অবস্থিত। যেগুলি কালের নিয়মে ভূগর্ভে স্থান পেয়েছে। এইসব মন্দিরগুলিতে টেরাকোটার সূক্ষ্ম কাজ এখনো বিদ্যমান এবং এইখানে যে বৈষ্ণব ধর্ম ছিল তার সাক্ষ্য বহন করে আসছে এই মন্দিরগুলি। এই গড় পঞ্চকোট পাহাড়ের মধ্যেই রয়েছে এক অপরূপ জলধারা। এই স্থানে মূলত আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। তাদের হাতের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কাজ, যেমন — খেজুর পাতায় তৈরি বিভিন্ন কারুকার্য বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দুই পাশে ঘন জঙ্গল মাঝে রাস্তা এবং মধ্যে ছোট ছোট পুকুর এই অঞ্চলের সৌন্দর্যের মাত্রাকে আরো বাড়িয়েছে।

গড় পঞ্চকোট
চিত্রঃ- পঞ্চরত্ন মন্দির

বর্তমানে এই অঞ্চলটি পর্যটন শিল্পের এক অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন রিসর্ট, হোটেল গড়ে উঠেছে। সম্প্রতি এখানে একটি ‘ওয়াচ টাওয়ার’ বসানো হয়েছে। সেখান থেকে এই পাহাড়ের সৌন্দর্য যে কি রকম তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। দেশ ও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এখানে এসে ভিড় জমাচ্ছেন। তার ফলে স্থানীয় মানুষদের কর্মসংস্থান ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু কালের সেই ধ্বংসের থাবা বসেছে এই গড় পঞ্চকোটে। প্রতিনিয়ত স্পঞ্জ আয়রন কারখানার ধোঁয়ায় এই পাহাড়ের ফুসফুসকে দগ্ধ করছে এবং মানব সভ্যতার কুঠারের আঘাতে শূন্য হতে বসেছে এই গড় পঞ্চকোটের কোল। তা সত্ত্বেও প্রকৃতি নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়াই করছে অবিরাম। এই গড় পঞ্চকোটের অনন্য সৌন্দর্য আমাকে খুবই আকৃষ্ট করেছে, তাই বারবার ছুটে যাই সৌন্দর্যের রূপ আস্বাদন করতে, এ যেন এক মন শান্তির পাঠশালা। আসুন একবার প্রত্যেকে দেখে যান।

লেখকঃ- সৌরভ লায়েক (টালিগঞ্জ কলোনী, ডিসেরগড়, পশ্চিম বর্ধমান)
[লেখক নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র]
তথ্যসূত্রঃ-
(১) ডঃ সুভাষ রায়ের প্রবন্ধ সংগ্রহ, পুরুলিয়ার ইতিহাস ও সংস্কৃতি (সম্পাদনা:- পার্থ সারথি ব্যানার্জী)
(২) পঞ্চকোট ইতিহাস – রাখাল চন্দ্র চক্রবর্তী
(৩) উইকিপিডিয়া
ব্যক্তি ঋণঃ-
(১) প্রতীক চ্যাটার্জী, কুলটি, পশ্চিম বর্ধমান
(২) অরবিন্দ মাঝি, গোবাগ, পুরুলিয়া
(৩) দেবলীনা অধিকারী পান্ডে, পুরুলিয়া
চিত্র সংগ্রাহকঃ- সৌরভ লায়েক

© মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া, ভূগোলিকা-Bhugolika, Geography & Environment, স্টুডেন্টস কেয়ার

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত