ভ্রমন অভিজ্ঞতায় মালবাজার – ডামডিমের বুদ্ধ মন্দির

ডুয়ার্স বরাবরই আমার কাছে বিশেষ ভালোলাগার একটি জায়গা। ডুয়ার্সের প্রতি দুর্বলতা রয়ে গেছে আমার সেই কলেজে পড়াশোনা করবার সময় থেকেই। ডুয়ার্সের নয়নাভিরাম চা বাগান, পাহাড়, ঝরনা, খরস্রতা নদী, শান্ত স্নিগ্ধ শীতল আবহাওয়া, বিভিন্ন জাতির মিশ্র সংস্কৃতি, পাহাড়ি খাবার দাবার প্রভৃতি বিষয়গুলো ভীষণভাবে আমার মনকে টানে, আকর্ষিত করে। তবে শুধু নিজের বললে ভুল হবে, যেকোনো ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কাছে ডুয়ার্সের একটা আলাদাই স্থান রয়েছে। বাড়ি দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটে হলেও স্কুল জীবনের শিক্ষা শেষ করে উচ্চতর শিক্ষলাভের উদ্দেশ্যে জলপাইগুড়ি আনন্দচন্দ্র কলেজে গমন এবং পরবর্তীতে নিজের বোনের বিবাহ সূত্রে মালবাজার শহরের সাথে আজীবন সংযোগ স্থাপন, অর্থাৎ পরিবেশ প্রকৃতি সাদর আমন্ত্রণের সাথে যেন ডুয়ার্সের শহীদ আমাকে এখনো বেঁধে রেখেছে। যাই হোক, ডুয়ার্সের বিভিন্ন পর্যটন ক্ষেত্র আমার আগেই মোটামুটি ঘোরা হয়েছে। সেগুলো বিভিন্ন পত্রপত্রিকার নানান সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।

Damdim Buddhist Monastery

এবারে কিছুদিন আগেই এই তীব্র দাবদাহে এবং ভোট উৎসবের মাঝেই হঠাৎ করেই সময় বের করে মালবাজার ঘুরে আসলাম বাইরের পর্যটকরা কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি বাসে বা ট্রেনে চেপে পৌঁছাতে পারেন। শিলিগুড়ি থেকে মালবাজারের দূরত্ব ৬২ কিমি। ডুয়ার্সের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণের ক্ষেত্রে মালবাজার শহর একটা জংশন বা বেস পয়েন্ট হিসেবেই বিবেচিত। এখানে আশেপাশে বহু হোটেল রিসোর্ট রয়েছে। মাত্র তিন দিনের জন্য এবারে মালবাজার গেছিলাম। প্রথম দিন আশেপাশের চা বাগান গুলো বিকেলের দিকে ঘুরে ফিরে আসলাম। অবশ্য প্রতিবার আসলেই আমি চা বাগানের দিকেই ঘুরতে চলে যাই। গোটা রাজ্য যখন তীব্র দহন জ্বালায় পুড়ছে, তখন ডুয়ার্সের এসব স্থানে গ্রীষ্মকালেও সূর্যের প্রখর উত্তাপ তেমন গায়ে লাগে না।একটা আলাদাই মিষ্টি শীতলতা এখানে বিরাজ করে। ঠিক ঘরে এয়ারকন্ডিশনার লাগালে যেমন আরাম মনে হয়।

যাই হোক দ্বিতীয় দিন একটা প্লান করলাম, আশেপাশের কোন একটা জায়গায় বেড়াতে যাব। আগেরবার ওদলাবাড়ি হয়ে গজল ডোবা গিয়েছিলাম,কিন্তু এবার কোথায় যাওয়া যায়!!! হঠাৎ করে মাথায় এলো, মালবাজার থেকে কাছেই ডামডিমে একটা সুন্দর বুদ্ধ মন্দির বা মনাস্ট্রি আছে শুনেছি,সেখানেই টুক করে ঘুরে আসলে কেমন হয়!!! বোন – জামাই এর কাছে ভালো করে খোজ নিলাম। সকালের খাওয়া দাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়লাম ডামডিমের এর উদ্দেশ্যে। মালবাজার থেকে ডামডিম মাত্র ৭ কিমি। মালবাজার বাস স্ট্যান্ড থেকে ডামডিম যাওয়ার ছোটো গাড়ীতে চাপলাম। ডা মডিমে  নেমে একটা টোটো ভাড়া করে সোজা বুদ্ধমন্দিরের মূল গেটে এসে নামলাম। ডামডিম জায়গাটা মূলত পঞ্চায়েত এলাকায়। যাই হোক, তীব্র গরমে চড়া রোদের মধ্যে এসেও এখানে এসে আলাদা একটা প্রশান্তি পাওয়া গেল। প্রসঙ্গত, এই বুদ্ধমন্দির শুধু ভগবান বুদ্ধের পূজা অর্চনার পবিত্র স্থান নয়, এটি বৌদ্ধ দর্শন নিয়ে উচ্চতর শিক্ষা এবং গবেষণার কেন্দ্রও বটে। মনে একটা কৌতূহল জন্মালো,ঠিক করলাম এই স্থান সম্পর্কে বিশদে জানবো। ভগবান বুদ্ধ কে দর্শন এবং প্রণাম নিবেদন করবার পর মন্দিরের অফিসের দিকে এলাম। বেশ কয়েকজন বৌদ্ধ ভিক্ষু বা লামা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো। ওনাদের সাথে কথা বলে এবং কুশল বিনিময় করে মন্দিরের অফিস ইনচার্জ এর সাথে দেখা করলাম। বেশ কিছুক্ষণ ধরে কথোপকথন হলো। ডামডিমের এই বুদ্ধ মন্দিরের প্রকৃত নাম ,’Bokar Sheda Obar Chimeyling Institute for Higher Buddhist Studies and Research’। আমার নাম পরিচয় জানানোর পর অফিস ইনচার্জ ‘ দাওয়া ‘ মহাশয়ের নিকট হইতে এই মন্দির সম্পর্কে নানান তথ্য সংগ্রহ করলাম। তিনি জানালেন এই বুদ্ধ মন্দির ২০০৬ সালে স্থাপিত হয়েছিল। মাঝে ২০০৯-২০১৫ সাল অবধি বিশেষ কারণবশত মন্দির নির্মাণের কাজ বন্ধ ছিল। ২০১৬ সালে পুনরায় কাজ শুরু হয় এবং ২০১৯ সালে মন্দিরের সমস্ত কাজ সমাপ্ত হয়ে দর্শনার্থী ও আপামর পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। কথা চলছিলো ‘দাওয়া ‘ মহাশয়ের সাথে।তিনি জানালেন এই মন্দির তথা এই প্রতিষ্ঠানে বৌদ্ধ দর্শন নিয়ে বিস্তারিত চর্চা করা হয়ে থাকে। বৌদ্ধ শিক্ষা মূলত পাঁচটি সূত্রের ওপর গঠিত। সেগুলো হলো-

১) বিনায়ক সূত্র বা শিক্ষা, এই শাস্ত্রে নীতি,শৃঙ্খলা,আইন,আদেশ এগুলো নিয়ে অধ্যয়ন করা হয়।

২) অভিধর্ম সূত্র, এই শাস্ত্রে মূলত বৌদ্ধ দর্শন নিয়ে গবেষণা করা হয় এবং ডক্টরেট ডিগ্রী(Ph.D) প্রদান করা হয়। যারা এই ডিগ্রী লাভ করে তাদের ‘ আচার্য ‘ নামে সম্বোধন করা হয়।

৩) মাধ্যমক সূত্র বা শিক্ষা , এই শাস্ত্রে যোগ এবং ধ্যানের মাধ্যমে ভগবান বুদ্ধ কে স্মরণ করা হয়।

৪) প্রাঞ্জপারতা সূত্র, এই শাস্ত্রে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের উদার মন নিয়ে বেঁচে থাকা শেখানো হয়।

৫) প্রামাণ্য সূত্র, এই শাস্ত্রে মূলত বৌদ্ধ ধর্মের বুনিয়াদি শিক্ষা ও যুক্তিবাদী শিক্ষার পাঠ দেওয়া হয়। 

মোট ১৫ বছর লাগে সম্পূর্ণ শিক্ষা প্রক্রিয়া শেষ করতে। তাছাড়াও টিবেটিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস অনুযায়ী আট দিন ধরে এখানে বৌদ্ধ দেবতা ‘তারা দেবীর ‘ আরাধনা করা হয়।সামার রিট্রিটের সময় ৪৫ দিন ধরে বিশেষ পূজা অর্চনা করা হয়। এবং বছরের শেষে ৮ দিন ধরে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রক্ষক দেবতা ‘ হে বাজরার ‘ পূজা করা হয়ে থাকে। ” দাওয়া” মহাশয় এর সাথে কথা বলে আরও জানা গেল এই বুদ্ধমন্দিরে বর্তমানে ৩৫০ জন শিক্ষক এবং ছাত্র রয়েছে। এদের মধ্যে ৩০ জন বৌদ্ধ দর্শন শিক্ষক এবং বাকিরা শিক্ষার্থী। প্রতিটি শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক এখানে দিনের নির্দিষ্ট সময়সূচী অনুসারে নিজস্ব কাজকর্ম ,পড়াশোনা ইত্যাদি সম্পাদন করে থাকে। ডাম ডিমের এই বুদ্ধ মন্দিরের প্রধান কার্যালয় হল মিরিক মনাস্ট্রি। ভেতরের পরিবেশ একেবারে সাজানো-গোছানো মন মুগ্ধকর। মূল গেট থেকে সামান্য কিছুটা ভেতরেই রয়েছে হিন্দুদের দেবীর তিনটি দেওয়াল মূর্তি। সামনে রং বেরঙের পাথর দিয়ে সাজানো জলাধার। রয়েছে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী এবং সংবিধান প্রণেতা ড: বি আর আম্বেদকর এর দুটি স্ট্যাচু।যা সর্বধর্ম শ্রদ্ধা এবং দেশ ভক্তির পরিচায়ক। তবে সমস্যা একটাই, ডাম ডিম থেকে এখানে আসার রাস্তাটা বেশ খারাপ। ” দাওয়া” মহাশয় খানিক আক্ষেপ করে জানালেন, ” রাস্তা সংস্কার এবং স্ট্রিট লাইট এর ব্যাপারে জানানো হয়েছে,কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন থেকে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তথাপি রাত্রে এখানে বন্য জন্তু বের হয়, তারও একটা ভয় আছে বৈকি”।

সবশেষে মোটামুটি সব তথ্য জানার পর “দাওয়া” মহাশয় কে প্রণাম জানিয়ে মন্দির চারপাশ টায় খানিকটা ঘুরে মুল গেট থেকে বেরিয়ে টোটো চেপে আবার ডামডিম চলে এলাম। সেখান থেকে বাসে করে মালবাজার। সংক্ষিপ্ত এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় অনেক কিছু জানলাম, দেখলাম,অনুধাবন করলাম।আপনারাও এখানে বেড়াতে যেতেই পারেন।নিজেদের পর্যটন ক্ষেত্রকে আরো সমৃদ্ধ করতেই পারেন।


 

 

সজল মজুমদার, শিক্ষক ,বালাপুর উচ্চ বিদ্যালয় (উ:মা:) তপন, দক্ষিণ দিনাজপুর

 

©Mission Geography India

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত