নদীবাঁধ ও ভূগোলদর্শন
নদীবাঁধ ও ভূগোলদর্শন
“কেন মরে গেল নদী।
আমি বাঁধ বাঁধি তারে চাহি ধরিবারে
পাইবারে নিরবধি,
তাই মরে গেল নদী”।
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৮৯৬ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর চিত্রা কাব্যগ্রন্থের দুরাকাঙ্ক্ষা কবিতায় তৃতীয় পরিচ্ছেদে উপরের কথাগুলো লিখেছেন। আবার তিনি অন্যত্র বলছেন ‘… ওগো নদী আপন বেগে পাগল পারা’। অর্থাৎ, তাঁর কথায় নদী তার উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত চলার পথে সে তার নিজের খেয়ালে চলে। তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় খেলা করে চলে। তাই নদী তার গতিপথের দুদিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে তার চলার পথে খেলা করার জায়গা খুঁজে নেয়। মানচিত্রের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় নদী তার হাজার হাজার বছর প্রবাহের ইতিহাসে বারবার প্রবাহখাত পরিবর্তন করলেও তা কিন্তু একটা নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। নদীবিজ্ঞানের ভাষায় একে নদীর এরেনা (Arena) বলা হয়।
মানবসভ্যতার বিকাশে নদীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করে নদীকে উন্নয়নের জীবনরেখা বলে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে প্রবহমান জলধারা মানুষের জীবন জীবিকার একমাত্র সঞ্জীবনী শক্তিসম। কখনো কূল ছাপিয়েএকের পর এক জনপদ ভাসিয়েছে, আবার কখনো ঘর ভেঙেছে, নষ্ট করেছে ফসল। কিন্তু, মানুষ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় নি। তার শীতল জলধারায় মানুষ পেয়েছে অমৃতের স্বাদ, কারণ নদীই জীবনের প্রকৃত অর্থ তুলে ধরেছে আমাদের সামনে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য প্রকৃতির উপর বসিয়েছি আমাদের লোভের করাল থাবা। বিজ্ঞানের সাহায্যে নদীর বুকে বসিয়েছি দীর্ঘকায় বাঁধ, নদীকে করতে চেয়েছি নিয়ন্ত্রণ। আন্তঃরাজ্য বা আন্তঃরাষ্ট্র জলবণ্টন বিতর্ক কাটাতে নদীতে অনেক সময় বাঁধ দেওয়া জরুরী হয়ে পড়েছিল। এই সমস্যা দীর্ঘ কয়েক দশকের। তবে নদীতে বাঁধ দেওয়ার কারণ বহুমুখী। ছোটবেলা থেকে ভূগোলের পাতায় বহুমুখী নদীপরিকল্পনার কথা শুনে আসছি আর তার সাথে নদীবক্ষেবাঁধনির্মাণের কথা জড়িয়ে থাকে। সাধারণত, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, বন্যা প্রতিরোধ এবং জলসেচের মতো মহতী উদ্দেশ্য নিয়ে কোন রাষ্ট্র তার নদীর উপর বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকে।
কিন্তু, সমস্যা হল এই বাঁধ নির্মাণের মধ্যে দিয়ে উদ্ভূত সমস্যার কতটা সমাধান পাওয়া যায় তা বিচারের পাশাপাশি এর ফলে একটা নদী বা তার অববাহিকাজুড়ে কি ধরনের প্রাকৃতিক বা আর্থ-সামাজিক সমস্যা নতুন করে তৈরি হয় সেটা মাথায় রাখা জরুরী। পূর্বেই বলেছি নদী তার চলার পথে উপত্যকার দুই পাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে দীর্ঘসময়ের অবকাশে খেলা করে। সেই সুযোগ না রাখলে নদী সভ্যতার উন্নয়নের চাবিকাঠি না হয়ে ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে আর তা আমাদের নিজেদের কারণে। মহাত্মা গান্ধীর কথায়, ‘The World has enough for everyone’s need, but not enough for everyone’s greed.’। তাই আমাদের লালসা পূরণে প্রকৃতির উপর অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ আনতে চাইলে তা ক্ষতিই ডেকে আনবে।
ভারতবর্ষের নদীবাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত আলোচনা অনেকদিন আগে থেকে হয়ে এলেও বেশীরভাগ প্রকল্প স্বাধীনতা বা তার পরবর্তীকালে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। দীর্ঘদিনের পরাধীনতার গ্লানি, দীর্ঘ বঞ্চনার পরে ক্ষমতার স্বাদ, উন্নয়নে অতিরিক্ত তৎপরতা এবং অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিভাজনে নদীর প্রাকৃতিক অবস্থানে নদীর জলবণ্টনে নিয়ন্ত্রণ আনা- নানা কারণে নদীবাঁধ নির্মাণে নানান জটিলতা তৈরি হয়। সেই নদীবাঁধ নির্মাণে যেমন সেচবাস্তুকার ছিলেন, তেমন পরিবেশবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যদের পাশাপাশি বিজ্ঞানীদের মতামত গুরুত্ব দেওয়ার কথা হয়েছিল। তা না করে মানুষের ক্ষমতা আর দম্ভকে সঙ্গে নিয়ে পরিবেশকে আত্মসাৎ করতে চাইল, ফলশ্রুতিতে, কয়েক দশকের মধ্যে বেশ কয়েকটি নদী বাংলা তথা ভারতবর্ষের বুক থেকে কালের ক্রমবিবর্তনে হারিয়ে গেল। রয়ে গেল পুরানো ইতিহাসের মানচিত্রের পাতায়। যা দেখলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদেরকে ক্ষমা করবে না।
লেখকঃ সনৎকুমার পুরকাইত, সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, রায়দিঘি কলেজ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)।
©Mission Geography India