মৃত্তিকা ভূগোলের নির্বাচিত প্রশ্নোত্তর || পর্ব-১

★ মৃত্তিকা ভূগোল ★

(১) পেডোলজি (Pedology) বলতে কী বোঝো?
উত্তরঃ- মৃত্তিকা বিজ্ঞানের যে শাখায় মৃত্তিকার উৎপত্তি, এর রাসায়নিক উপাদান, প্রাকৃতিক গুণাগুণ, গঠন বৈচিত্র্য, উৎপাদন ক্ষমতা, জলবায়ুর প্রভাব, উদ্ভিদের প্রভাব, শ্রেণীবিভাগ প্রভৃতি পর্যালোচনা করা হয়, তাকে পেডোলজি বলে। বিজ্ঞানী রবিনসনের মতে, ‘পেডোলজি হচ্ছে মৃত্তিকার রসায়ন, পদার্থ, ভূতত্ত্ব প্রভৃতি পরস্পর নির্ভরশীল বিষয়গুলোর সমন্বয়ে গঠিত বিজ্ঞান।’

(২) ইডাফোলজি (Edaphology) বলতে কী বোঝো?
উত্তরঃ- মৃত্তিকা বিজ্ঞানের যে শাখায় মৃত্তিকা ও উদ্ভিদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আলোচনা করা হয়, তাকে ইডাফোলজি বলে। উদ্ভিদের জন্ম, বৃদ্ধি ও বিকাশ মৃত্তিকার সাথে কীভাবে সম্পর্কিত তা ইডাফোলজিতে আলোচনা করা হয়।

(৩) মৃত্তিকা কাকে বলে?
উত্তরঃ- সাধারণ অর্থে ভূপৃষ্ঠের উপরের নরম আবরণের নামই মৃত্তিকা। মৃত্তিকা বিজ্ঞানী জফির মতে ‘মৃত্তিকা হচ্ছে একটি প্রকৃতিজাত বস্তু, যা খনিজ ও জৈব পদার্থের সমন্বয়ে বিভিন্ন গভীরতা বিশিষ্ট স্তরবিন্যাসে গঠিত এবং যা আদি বস্তুর দৈহিক, ভৌতিক, রাসায়নিক ও জৈবিক ধর্মে স্বতন্ত্র।’ রমনের মতে, ‘মৃত্তিকা হল পৃথিবী পৃষ্ঠের অবিরত ক্ষয়শীল একটি স্তর।’

(৪) কিভাবে মৃত্তিকার উৎপত্তি হয়?
উত্তরঃ- মৃত্তিকার উৎপত্তি প্রধানত তিনটি পদ্ধতিতে হয়ে থাকে — (A) শিলাস্তরের আবহবিকারের (তাপ ও শৈত্য জনিত প্রসারণ, শল্কমোচন হাইড্রেশন, হাইড্রোলিসিস, কার্বনেশন, অক্সিডেশন) মাধ্যমে শিলাখণ্ড চূর্ণবিচূর্ণ হয় (B) এলুভিয়েশন প্রক্রিয়ায় ওই শিলাখণ্ডের খনিজ ও জৈব কণা ভৌত ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় চলাচল করে (C) ইলুভিয়েশন প্রক্রিয়ায় ওই সব শিলা উপাদান মৃত্তিকা পরিলেখের B স্তরে জমা হয় এবং মৃত্তিকার উৎপত্তি ঘটায়।

(৫) মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রভাবক গুলি কিকি?
উত্তরঃ- মৃত্তিকা সৃষ্টির সক্রিয় বা প্রত্যক্ষ প্রভাবকগুলি হল — (A) জলবায়ুঃ- (i) উষ্ণতার প্রভাব (ii) আর্দ্রতার প্রভাব (iii) বায়ুপ্রবাহের প্রভাব ; (B) জীবজগৎঃ- (i) উদ্ভিদের প্রভাব (ii) প্রাণীর প্রভাব।
মৃত্তিকা সৃষ্টির পরোক্ষ প্রভাবকগুলি হল — (A) আদিশিলা/জনক শিলা (B) ভূমিরূপ/ভূপ্রকৃতি (C) সময়।

(৬) মৃত্তিকা সৃষ্টিতে জলবায়ুর ভূমিকা কীরূপ?
উত্তরঃ- মৃত্তিকা সৃষ্টিতে জলবায়ুর প্রভাব অন্যতম। বিভিন্ন ধরনের অধঃক্ষেপণ যেমন মৃত্তিকার আর্দ্রতা সৃষ্টি করে তেমনি উষ্ণতা আবার মৃত্তিকাকে শুষ্কও করে। এই উত্তাপ ও অধঃক্ষেপনের উপর শিলার যান্ত্রিক ও রাসায়নিক আবহবিকার প্রভাবিত হয়। মৃত্তিকার আর্দ্রতা যেমন N2, C, H2 এর বিনিময় ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, তেমনি তাপমাত্রা মৃত্তিকার জৈবপদার্থের বিশ্লেষণ ক্ষমতা ও জীবাণুর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে মৃত্তিকা গঠনে সাহায্য করে।

(৭) ভ্যান্ট হফের সূত্রটি কী?
উত্তরঃ- মৃত্তিকা সৃষ্টিতে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সক্রিয় নিয়ন্ত্রক হল তাপমাত্রা। বিজ্ঞানী ভ্যান্ট হফ ১৮৮৪ সালে বলেন, প্রতি ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে মৃত্তিকাতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার হার প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। এই সূত্রকেই বলা হয় ভ্যান্ট হফের সূত্র।
উদাহরণঃ- এই তাপমাত্রার পার্থক্যের জন্যই শীতল তুন্দ্রা অঞ্চলের তুলনায় উষ্ণ ক্রান্তীয় অঞ্চলে মৃত্তিকা সৃষ্টির হার কয়েকগুণ বেশী।

(৮) মৃত্তিকা সৃষ্টিতে জীবজগতের ভূমিকা কিরূপ?
উত্তরঃ- উদ্ভিদ ও জীবজগতের সক্রিয় ভূমিকা মৃত্তিকা সৃষ্টির অন্যতম জৈব ভিত্তি। যেমন — (I) প্রেইরী ও স্টেপ তৃণভূমি অঞ্চলের জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ চারনোজেম মৃত্তিকা (II) উদ্ভিদের বর্জ্য পদার্থ থেকে হিউমাস সমৃদ্ধ মৃত্তিকা (III) সরলবর্গীয় বৃক্ষ অঞ্চলে আম্লিক পডজল মৃত্তিকা (IV) মৃত্তিকাতে বসবাসকারী কেঁচো, পিঁপড়ে, উই ইত্যাদি প্রাণী কর্তৃক বিভিন্ন যান্ত্রিক ও রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপে মৃত্তিকার গ্রথন ও রাসায়নিক গঠনে পরিবর্তন (V) ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া প্রভৃতি আণুবীক্ষণিক জীব গোষ্ঠী কর্তৃক জৈব পদার্থ গঠন, হিউমাস গঠন, জারণ-বিজারণের মাধ্যমে মৃত্তিকা গঠনে সাহায্য।

(৯) মৃত্তিকা গঠনে মানুষের প্রভাব কিরূপ?
উত্তরঃ- মৃত্তিকার ক্রমবিকাশে মানুষের ভূমিকা খুব বৈচিত্র্যময়, কারণ মানুষ যেমন একদিকে অবাধ ভূমিকর্ষণ, বনভূমি ধ্বংস ইত্যাদি নেতিবাচক কাজ দ্বারা মৃত্তিকার গুনগুন পাল্টে দেয়, তেমনি অন্যদিকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মৃত্তিকার পরিচর্যা, শস্যাবর্তন, ধাপ চাষ ও ঝুম চাষ নিয়ন্ত্রণজনিত ইতিবাচক পদক্ষেপ দ্বারা মৃত্তিকার পুনর্গঠনে ভূমিকা নেয়। যেমন — আফ্রিকার সোমালিয়া সহ অনেক দেশের প্রাচীন অধিবাসীরা প্রকৃতি থেকে সরাসরি মৃত্তিকা তৈরি করেন।

(১০) আদি বা জনক শিলা কী?
উত্তরঃ- ভূত্বকে অবস্থিত যে সমস্ত শিলা থেকে ধীর পদক্ষেপে আবহবিকার জনিত কারণে সময়ের সাপেক্ষে মৃত্তিকার উদ্ভব হয়, তাদের আদি বা জনক শিলা (Parent Rock) বলে। ইহা কঠিন ও কোমল উভয়ই হতে পারে। জনক শিলার কাঠিন্যতার উপরেই মৃত্তিকা সৃষ্টির হার নির্ভর করে। এর মূলত দুটি ভাগ রয়েছে, যথা — (A) অবশিষ্ট জনক শিলা (B) অবক্ষেপিত জনক শিলা।

(১১) মৃত্তিকা সৃষ্টিতে আদি বা জনক শিলার প্রভাব কীরূপ?
উত্তরঃ- মৃত্তিকা সৃষ্টিতে আদি শিলার ভূমিকা নিস্ক্রিয়। আবহবিকার ও সঞ্চয়ের মাধ্যমে জনক শিলা থেকে মৃত্তিকা তৈরি হয়। কিন্তু মৃত্তিকার গঠন, গ্রথন, রং, রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য অনেকাংশে জনক শিলার ওপর নির্ভর করে। যেমন — (I) গ্রানাইট ও রায়োলাইট থেকে স্থূল গ্রথনযুক্ত অম্ল ধর্মী বেলে মৃত্তিকা (II) ব্যাসল্ট থেকে মসৃণ ক্ষারকীয় এঁটেল মৃত্তিকা (III) চুনাপাথর থেকে রেনজিনা মৃত্তিকা গড়ে ওঠে।

(১২) মৃত্তিকা সৃষ্টিতে ভূপ্রকৃতির প্রভাব কীরূপ?
উত্তরঃ- মৃত্তিকা সৃষ্টিতে ভূপ্রকৃতির ভূমিকা নিস্ক্রিয়। কিন্তু ভূমির উচ্চতা, বন্ধুরতা, ঢালের উপর নির্ভর করে মৃত্তিকার স্তর ও গভীরতা গঠিত হয়, যেমন — (I) পাহাড়ী অঞ্চলে ভূমির অত্যধিক ঢালের জন্য ভূমি ক্ষয়ের প্রভাবে মৃত্তিকা স্তর পাতলা (৫-১০ সেমি) হয়। (II) সমভূমি অঞ্চলে ভূমির ঢাল কম ফলে ভূমিক্ষয় কম হওয়ার জন্য গভীর স্তর যুক্ত মৃত্তিকা গঠিত হয়। (III) মরুভূমিতে সিরোজেম, নদী উপত্যকায় পলি, উপকূল ভাগে উপকূলীয়, দাক্ষিণাত্যের মালভূমিতে রেগুর মৃত্তিকা লক্ষ্য করা যায়।

(১৩) মৃত্তিকা ক্যাটেনা (Soil Catena) বলতে কী বোঝ?
উত্তরঃ- ল্যাটিন শব্দ ‘ক্যাটেনা’ বলতে বোঝায় ‘Chain’ বা ‘শৃঙ্খল’। একটি নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক ঢাল বরাবর যখন মৃত্তিকাগুলি পর পর নিজেদের মধ্যে এবং ভূপ্রকৃতির সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠিত হয়, তখন তাকে মৃত্তিকার ক্যাটেনা বলে। এক কথায় মৃত্তিকার ক্যাটেনা হল ভূপ্রাকৃতিক বিন্যাস। অস্ট্রেলিয়ার ভূবিজ্ঞানী G. Milne (১৯৩৫) ‘ক্যাটেনা’ ধারণাটির উদ্ভাবন করেন।

(১৪) মৃত্তিকা সৃষ্টিতে সময়ের ভূমিকা কীরূপ?
উত্তরঃ- শুরু থেকে পরিণত অবস্থায় একটি আদর্শ মৃত্তিকা সৃষ্টি হতে হাজার হাজার বছর সময় লাগে। মাত্র ২ সেমি পুরু মৃত্তিকা তৈরি হতে ৫০০ বছর সময় লাগে। কম সময় ধরে মৃত্তিকা সৃষ্টির উপাদানগুলো কাজ করলে মৃত্তিকা হয় অপরিণত, যেমন – রেন্ডজিনা। অনুকূল পরিবেশে মৃত্তিকার A, B, C তিনটি স্তর গঠিত হতে অন্তত কয়েকশো বছর সময় লাগে, যেমন — নদীর ধারে সঞ্চিত পলি হিমবাহের গ্রাবরেখা প্রভৃতি অল্প দিনে সঞ্চিত হওয়ায়, এগুলিতে উন্নত পরিলেখ গঠিত হয় না।

(১৫) পেডোলজি ও ইডাফোলজির মধ্যে পার্থক্য কি?
উত্তরঃ- (I) মৃত্তিকা বিজ্ঞানের যে শাখায় মৃত্তিকার উৎপত্তি, ধর্ম, শ্রেণীবিন্যাস প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়, তাকে পেডোলজি বলে। অন্যদিকে, যে শাখায় উদ্ভিদের উৎপত্তি, বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের আলোচনা করা হয়, তাকে ইডাফোলজি বলে। (II) আবহাওয়া ও জৈবিক প্রক্রিয়ার ফলে বিশ্লিষ্ট শিলাকণা থেকে কীভাবে মৃত্তিকার সৃষ্টি হয় তা পেডোলজি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ; যেখানে ইডাফোলজি মৃত্তিকা ও উদ্ভিদের মধ্যবর্তী সম্পর্কের ভিত্তিতে বীজের অঙ্কুরোদগম, উদ্ভিদের জীবনচক্র সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। (III) পেডোলজি মৃত্তিকা ভূগোলের এবং ইডাফোলজি মৃত্তিকা ও জীব ভূগোলের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

(১৬) মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়াগুলি কী কী?
উত্তরঃ- যে প্রক্রিয়ায় আদি শিলা থেকে মৃত্তিকা পরিপূর্ণতা লাভ করে, তাকে মৃত্তিকার গঠন প্রক্রিয়া বলে। মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়াগুলো হল — (A) প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াঃ- (I) স্তূপীকরণ (II) স্থান পরিবর্তন (III) দ্রবণ আকারে স্থানান্তরণ (IV) ভাসমান অবস্থায় স্থানান্তরণ ; (B) রাসায়নিক প্রক্রিয়াঃ- (I) জলযোজন (II) হাইড্রোলিসিস (III) অঙ্গারযোজন ; (C) জৈবিক প্রক্রিয়াঃ- (I) স্থানান্তরণ (II) নাইট্রোজেন বিশ্লিষ্টকরণ ; (D) যৌগিক প্রক্রিয়াঃ- (I) হৃতমানকরণ (II) চুয়ীসরণ (III) পডজলিকরণ ইত্যাদি।

(১৭) মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রাথমিক প্রভাবকগুলি কী কী?
উত্তরঃ- ভূপৃষ্ঠের সকল মৃত্তিকা সৃষ্টির পিছনে কয়েকটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ভূমিকা নেয়, যেমন — (১) সংযোজনঃ- মাটিতে জল, জৈব পদার্থ, খনিজ পদার্থ, সৌরতাপ সংযোজিত হয়। (২) অপসারণঃ- জল বাষ্পীভূত হয় এবং জৈব পদার্থের অপসারণ ঘটে। (৩) রূপান্তরণঃ- মৃত্তিকা মধ্যস্থ খনিজ ও জৈব পদার্থের ভৌত ও রাসায়নিক রূপান্তর ঘটে। (৪) চলন বর্জনঃ- মৃত্তিকাতে জল চুঁইয়ে নীচে প্রবেশের সময় দ্রাব্য পদার্থ কাদা, জৈব পদার্থ ও জল যুক্ত অক্সাইড নীচের স্তরে স্থানান্তরিত হয়।

(১৮) এলুভিয়েশন (Eluviation) কাকে বলে?
উত্তরঃ- মৃত্তিকা সৃষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক প্রক্রিয়া এলুভিয়েশন। এর অর্থ হল ‘ধৌতকরণ’। যে পদ্ধতিতে অনুস্রবণরত জলের সাথে মৃত্তিকাস্থিত উপাদানগুলি প্রলম্বিত বা দ্রবীভূত অবস্থায় ঊর্ধ্বস্তর থেকে নিম্নস্তরে ক্ষরিত হয়, তাকে এলুভিয়েশন বলে। ইহা দুই প্রকারের, যথা – যান্ত্রিক ও রাসায়নিক। এলুভিয়েশনের হার বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা প্রভৃতির উপর নির্ভরশীল।

(১৯) ইলুভিয়েশন (Illuviation) কাকে বলে?
উত্তরঃ- মৃত্তিকা সৃষ্টির অপর এক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক প্রক্রিয়া ইলুভিয়েশন। যে প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকার ঊর্ধ্বস্তর বা A স্তর বা এলুভিয়েশন স্তর থেকে মৃত্তিকাস্থিত খনিজ দ্রব্যগুলি যান্ত্রিক বা রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে নীচে নেমে ‘B’ স্তরে সঞ্চিত হয় তাকে ইলুভিয়েশন প্রক্রিয়া বলে। অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে ইলুভিয়েশন সংঘটিত হয় প্রায় ১৫০ সেমি গভীরতায়, কম বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে এই গভীরতা ৫০ সেমি।

(২০) ধৌত প্রক্রিয়া (Leaching) কাকে বলে?
উত্তরঃ- যে প্রক্রিয়ায় সহজ দ্রবণীয় বিভিন্ন জৈব ও অজৈব পদার্থ যেমন খনিজ লবণ, বিভিন্ন জৈব ও অজৈব অ্যাসিড ইত্যাদি জলে দ্রবীভূত হয়ে নিম্নস্থ মৃত্তিকা স্তরে স্থানান্তরিত হয়, তাকে ধৌত প্রক্রিয়া বা লিচিং বলে। এই প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট মৃত্তিকা হল অম্লধর্মী, যেমন – পডজল। সাধারণত শীতল, আর্দ্র পর্ণমোচী বৃক্ষের বনভূমিভাগে এই প্রক্রিয়া অধিক কার্যকর হয়।

(২১) ল্যাটেরাইজেশন (Laterization) কাকে বলে?
উত্তরঃ- ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা গঠনের প্রক্রিয়াকে ল্যাটেরাইজেশন বলে। যে প্রক্রিয়ায় ক্রান্তীয় উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুতে বর্ষাকালে মৃত্তিকার উপরের স্তর থেকে মৃত্তিকা ধুয়ে যাবার সময় বালি বা সিলিকার অক্সাইড অপসারিত হয় এবং লোহা ও অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড মৃত্তিকার উপরের স্তরে বা সামান্য গভীরতায় সঞ্চিত থেকে যায়, তাকে ল্যাটেরাইজেশন বলে।

(২২) পডজলাইজেশন (Podzolization) কাকে বলে ?
উত্তরঃ- পডজল মৃত্তিকা গঠনের প্রক্রিয়াকে পডজলাইজেশন বলে। শীতল নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে যেসব স্থানে বৃষ্টিপাত তুলনামূলক কিছুটা বেশী, সেসব স্থানে মৃত্তিকার উপরের সিলিকা সমৃদ্ধ পদার্থগুলো জমে লোহা ও অ্যালুমিনিয়ামের অপসারিত হওয়ার এবং ‘B’ স্তরে সঞ্চিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে পডজলাইজেশন বলে। এই পদ্ধতিতে ধূসর বা ছাই রঙের মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়।

(২৩) ক্যালসিফিকেশন (Calsification) কাকে বলে?
উত্তরঃ- মৃত্তিকা পরিলেখের কোন এক স্থানে ক্যালসিয়াম কার্বনেটের সঞ্চয় যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে, তাকে ক্যালসিফিকেশন বলে। তৃণভূমি অঞ্চলে, যেখানে কম বৃষ্টিপাত হয় সেখানে এই প্রক্রিয়া কাজ করে। এই পদ্ধতিতে চুনাপাথরযুক্ত অঞ্চলে পেডোক্যাল মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়। নাতিশীতোষ্ণ তৃণভূমিতে এর ফলে চারনোজেম মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়।

(২৪) হিউমিফিকেশন (Humification) কাকে বলে?
উত্তরঃ- আর্দ্র বা উপ-আর্দ্র জলবায়ু যুক্ত অঞ্চলে যে পচনমূলক প্রক্রিয়ায় জৈব পদার্থ সমূহ হিউমাসে পরিণত হয় তাকে হিউমাস গঠন প্রক্রিয়া বা হিউমিফিকেশন বলে। বিভিন্ন জীব তথা ব্যাকটেরিয়া, ফাংগি, কেঁচো, উই প্রভৃতি জৈব পদার্থের পচনের এরূপ জটিল প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে।

(২৫) স্যালিনাইজেশন (Salinization) কাকে বলে?
উত্তরঃ- লবণাক্ত বা সোলানচাক মৃত্তিকা সৃষ্টির একটি প্রক্রিয়া হল স্যালিনাইজেশন। যে প্রক্রিয়ায় মরু ও মরুময় অঞ্চলে জলাভাবে মৃত্তিকা পরিলেখতে Ca, Mg, Na ও K এর সালফেট, ক্লোরাইড প্রভৃতি লবণ সঞ্চিত হয় তাকে স্যালিনাইজেশন বলে। এই প্রক্রিয়ায় গঠিত মৃত্তিকাতে সাধারণ লবণের পরিমাণ হয় ২% এবং PH ৮.৫ বা তার বেশী।

(২৬) গ্লেইজেশন (Gleization) কাকে বলে?
উত্তরঃ- প্রধানত জলমগ্ন বা জলাভূমি এলাকার মৃত্তিকাতে অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকায় ক্ষুদ্র জীবাণুসমূহ মৃত্তিকাস্থিত জৈব পদার্থ জারণের পরিবর্তে বিজারণ প্রক্রিয়ায় জৈব অম্লের সৃষ্টি করে। ফলে পুরোপুরি জলে সম্পৃক্ত থাকায় ধৌতকরণ না হওয়ার জন্য মৃত্তিকা স্বাভাবিক বাদামী রঙের পরিবর্তে নীলাভ বাদামী বা ধূসর রঙের হয়। মৃত্তিকা গঠনের এই প্রক্রিয়াকে গ্লেইজেশন বলে।

(২৭) অ্যালক্যালাইজেশন (Alkalization) কাকে বলে ?
উত্তরঃ- যে প্রক্রিয়ায় শুষ্ক মরু অঞ্চলে মৃত্তিকার কাদাকণা যৌগে Ca, Mg প্রভৃতি আয়নের থেকে Na আয়ন বেশী জমা হয়, তাকে অ্যালক্যালাইজেশন বলে। Na আয়ন কাদাকণা ও জৈব পদার্থের সাথে বিক্রিয়া করে মৃত্তিকাকে অতি মাত্রায় ক্ষারকীয় করে তোলে এবং মৃত্তিকার চারধারে কালো রঙের আবরণ তৈরী করে।

(২৮) ফেরালাইটজেশন (Feralitezation) কাকে বলে?
উত্তরঃ- যে প্রক্রিয়ায় আর্দ্র গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুর অধিক বৃষ্টিপাত এবং বেশী তাপে প্রধান বা মূল শিলা কেওলিনাইট ও সেসক্যুই অক্সাইড সমৃদ্ধ মৃত্তিকাতে পরিণত করে, তাকে ফেরালাইটজেশন বলে। এই প্রক্রিয়া কালে মৃত্তিকা আম্লিক হয়ে পড়ে। এই প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন মৃত্তিকা হল চারনোজেম, ফেরালাইটিক প্রভৃতি।

(২৯) খনিজকরণ (Mineralization) কাকে বলে?
উত্তরঃ- যে প্রক্রিয়ায় হিউমাস গঠনকারী খনিজ পদার্থ গুলি পুনরায় মৃত্তিকাতে মেশে, তাকে খনিজকরণ বলে। সব মৃত্তিকাতেই এই প্রক্রিয়া কাজ করে, আবার এটি হিউমিফিকেশনের বিপরীত প্রক্রিয়া। এতে দীর্ঘকালীন ব্যবধানে হিউমাস বিয়োজিত হয় এবং মৃত্তিকাতে নাইট্রোজেন যৌগগুলি নির্গত হয়।

(৩০) মৃত্তিকার স্তরায়ন বা পরিলেখ কাকে বলে?
উত্তরঃ- অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে সৃষ্ট পরিণত বা আদর্শ মৃত্তিকার পৃষ্ঠদেশ থেকে নীচে মূল বা আদি শিলা পর্যন্ত প্রস্থচ্ছেদ করলে ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে কয়েকটি স্তর গড়ে ওঠার চিত্র ধরা পড়ে, একে মৃত্তিকা পরিলেখ বলে। মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ভি.ভি.ডকুচেভ প্রথম এর ধারণা দেন। একটি পরিণত মৃত্তিকার স্তরায়নে O, A, B, C, D — এই ৫টি স্তর বিদ্যমান।

সংকলনেঃ- গোপাল মন্ডল (চৌবাট্টা, বাঁকুড়া)
[সহকারী সম্পাদক, মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া]

©Mission Geography India

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত