গঙ্গার গ্রাস

গঙ্গার গ্রাস

হে মা গঙ্গে…
দেবপ্রয়াগ এ মিলিত নদীর রূপ তুমি।
তুমি যে অপরূপা, অমলিন জলধারা।
অজস্র শিলার বক্ষ চিরে
দিয়েছো সকলকে সাড়া।
তোমার জলে প্রাণ ফিরে পায়
কত না তৃষ্ণার্থ প্রাণ।
রুক্ষ পৃথিবীতে মৃত প্রাণে তুমি
করেছ যে জীবন দান।
সকলেরই জননী তুমি, তুমি হিমালয়ের দান।
শস্যের সম্ভার তুমি, তুমিই শিল্পের আধান।

একদিন অতীতে বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসু এক নদীকে জিজ্ঞাসা করেন “কোথা হইতে আসিয়াছো নদী?”, সেই নদীটি প্রত্যুত্তরে বলে — “মহাদেবের জটা হইতে”। আমি সেই মহাদেবের জটা থেকে ধরিত্রীর বুকে নেমে বয়ে চলা সবার চিরপরিচিত গঙ্গা।
প্রথমেই ছোট্ট একটি কবিতার মাধ্যমে গঙ্গার অবদান সম্পর্কে দু-চার লাইন লিখেই ফেললাম। আগে হয়তো কখনো সেইভাবে লেখালেখি করা হয়নি… তবে সাহস, আবেগ, উৎফুল্ল — সবমিলিয়ে লিখেই ফেললাম। ছোট্ট থেকে গঙ্গাকে নিয়ে কত কবিতা, কত গান বাঁধতে দেখেছি। পতিত পাবনী গঙ্গে… পূণ্য দায়িনী গঙ্গে… ছোট্ট থেকেই জানতাম গঙ্গা পবিত্র নদী। গঙ্গা মানে পবিত্র জল, যে জলে স্নান করলে নাকি সমস্ত পাপ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সেটা আর বলতে ইচ্ছা করে না। গঙ্গাকে নিয়ে আমি ঠিক এভাবে ভাবিনি কোনদিন। গঙ্গার বুকের উপর দিয়ে একসময় হাল টানা নৌকা দেখেছি। পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের লাল আভাকে অনুসরণ করে নৌকাকে যেতেও দেখেছি। কতই না সেই অপরূপ দৃশ্য। জোয়ারের সময় গঙ্গার উপর সূর্যের কিরণে চিকচিক করা জল বেশ টানে আমাকে। কিন্তু ভাটার সময় ঘোলা জল থেকে দূষণের গন্ধে মুখ ফেরাতে ইচ্ছা হয়। ভাদ্র, আশ্বিন মাসে কোটালের রূপ দেখতে হয়। গঙ্গা গ্রাস করে চারপাশের পার্থিব বস্তুকে। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে সেসব দৃশ্য দেখারও দুর্ভাগ্য করতে হয়। আবার পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের লাল আভা মাখা নদীর দু’পাড়ে ল্যান্ডস্কেপ ঢেউ খেলানো চাদরে মোড়া জল — একটা সিলুয়েটের মত। এক দক্ষ শিল্পী তার নিপুণ তুলির টানে রোজ রোজ এর চিত্র আঁকেন। যা কখনো কোনো মতে একঘেঁয়ে হয় না… হতেই পারে না। আবার শীতের শুরুতে কুয়াশামাখা গঙ্গার রূপ কম যায় না। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা, “ঘাটের কথা” গল্পে এ প্রসঙ্গে দু-চার লাইন মনে পড়ে যায়… “ভরা গঙ্গার উপরে শরৎ প্রভাতের যে রৌদ্র পড়িয়াছে তাহা কাঁচা সোনার মত রং, চাঁপা ফুলের মত রং, রৌদ্রের এমন রং আর কোন সময় দেখা যায় না। চড়ার উপরে কাশবনের উপরে রৌদ্র পড়িয়াছে”। আবার কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “যদি নির্বাসন দাও” — উদ্ধৃত করে বলা যায়… “ধানক্ষেতে চাপ চাপ রক্ত, এইখানে ঝরেছিল মানুষের ঘাম।
এখনো স্নানের আগে কেউ কেউ করে থাকে নদীকে প্রণাম। এখনো নদীর বুকে মোচার খোলায় ঘুরে লুটেরা ফেরারী”।

আমরা সকলেই জানি গঙ্গা ভারতের দীর্ঘতম ও বৃহত্তম নদী। হিমালয় থেকে নির্গত নদীগুলির মধ্যে গঙ্গা একটি। যদিও গঙ্গা দুটি নদীর মিলিত রূপ। একটি হল ভাগীরথী আর অপরটি হল অলকানন্দা। হিন্দু সংস্কৃতি অনুযায়ী ভাগীরথীকেই গঙ্গার মূল প্রবাহ বলে মনে করা হয়ে থাকে। এই ভাগীরথী নদীর উৎস হল হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ থেকে। এরপর এটি উত্তরকাশী, ধারাসু, তেহরি হয়ে দেবপ্রয়াগে অলকানন্দার সাথে মিলিত হয়। অন্যদিকে অলকানন্দা নদীর উৎপত্তি উত্তরাখণ্ডের শতোপন্থ এবং ভাগীরথী খড়ক হিমবাহ থেকে। তারপর নদীটি, বদ্রীনাথ হয়ে পাঁচটি প্রয়াগ অতিক্রম করে পঞ্চম প্রয়াগ অর্থাৎ দেবপ্রয়াগে এসে ভাগীরথীর সাথে মিলিত হয়। সংক্ষেপে প্রয়াগগুলিকে বলা যায় পঞ্চ প্রয়াগ। এগুলি হল — বিষ্ণুপ্রয়াগ (যেখানে ধৌলিগঙ্গা নদী অলকানন্দার সাথে মেশে), নন্দপ্রয়াগ (যেখানে নন্দাকিনী নদী অলকানন্দার সাথে মেশে), কর্ণপ্রয়াগ (যেখানে পিন্ডার নদী অলকানন্দার সাথে মেশে), রুদ্রপ্রয়াগ (যেখানে মন্দাকিনী নদী অলকানন্দার সাথে মেশে), আর শেষ প্রয়াগ দেবপ্রয়াগ (যেখানে ভাগীরথী এবং অলকানন্দা নদী পরস্পর মিলিত হয়) এবং একটি নদী রূপে বয়ে যায়। যার নাম গঙ্গা।

গঙ্গার জন্ম কাহিনী বিষয়ে হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ গুলির মধ্যে আবার মতভেদ দেখা যায়। একটি কাহিনী অনুযায়ী… ব্রহ্মার কমণ্ডলু এক নারীমূর্তির স্বরূপ প্রাপ্ত হয়। ইনিই গঙ্গা। বৈষ্ণব মতানুসারে, ব্রহ্মা তার কমণ্ডলুর জল নিয়ে সশ্রদ্ধ চিত্তে বিষ্ণুর পদ ধৌত করেছিলেন। সেই থেকেই গঙ্গার জন্ম। আবার একটি মত অনুযায়ী, গঙ্গা পর্বতরাজ হিমালয় ও তার পত্নী মেনকার কন্যা এবং পার্বতীর ভগিনী। তবে প্রতিটি মতেই একথা স্বীকৃত যে ব্রহ্মা, গঙ্গাকে পবিত্র করে তাকে স্বর্গে উত্তীর্ণ করেন। মহাভারতে গঙ্গার উল্লেখ পাওয়া যায় যেখানে গঙ্গা তার পুত্রকে বিসর্জন দিয়েছিলেন… সেই সব কাহিনী আমাদের কম বেশী সকলেরই জানা আছে।

যাইহোক, গঙ্গা দেবপ্রয়াগে উৎপত্তির পর উত্তরাখন্ড, উত্তরপ্রদেশ, বিহার অতিক্রম করে ঝাড়খণ্ডের রাজমহল পাহাড়ের কাছ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে এবং মুর্শিদাবাদ জেলার ধুলিয়ানের মিঠিপুরের কাছে এসে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়। একটি শাখা পদ্মা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করে যা পরে যমুনা ও মেঘনা নদীতে মিলিত হয় এবং মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। মেঘনা ও যমুনা শুনে এ প্রসঙ্গে ভূপেন হাজারিকার একটা গানের সুর বেজে ওঠে কানে… “গঙ্গা আমার মা/ পদ্মা আমার মা/ ও আমার দুই চোখে দুই জলের ধারা/ মেঘনা যমুনা”… আর অপর শাখাটি ভাগীরথী-হুগলি নামে মুর্শিদাবাদ, নবদ্বীপ, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়।

বিগত কয়েক দশক ধরে গঙ্গা কত মানুষের সুখ-দুঃখের সাক্ষী হয়ে রয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। কত মানুষের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে রয়েছে তো আবার কত মানুষের শবদেহের ঘর। কখনো বা গঙ্গার একপাড় ভেঙেছে তো কখনো আবার একপাড় গড়েছে… তবে বর্তমান যুগে তা অবশ্য ভয়াবহ আকার ধারণ করে চলেছে দিনের পর দিন। গঙ্গার ভাঙ্গন সম্পর্কে আজকাল প্রায়ই খবরের কাগজে শিরোনাম জ্বলজ্বল করে থাকে। আগে অল্পবিস্তর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে গঙ্গার পাড় তবে তা সকলের কাছে জানার উপায় ছিল না… কিন্তু বর্তমান প্রচারের যুগে নদীর ভাঙ্গন সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু জানতে পারি। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ রয়েছে “Nature can change your life” — অর্থাৎ প্রকৃতি জীবনকে বদলে দিতে পারে। প্রকৃতি যেমন মানুষকে উজাড় করে সব কিছু দিতে পারে তেমনি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তা কেড়ে নিতে পারে। কারণ প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা অনুধাবন করা আজও আমাদের কাছে অসাধ্য সাধন। বর্তমান বিজ্ঞানের অগ্রগতির কাছেও আমরা অসহায়। তবে প্রকৃতিকে যদি তার স্বাভাবিক নিয়মে চলতে দেওয়া হয় তাহলে হয়তো বিপর্যয় কম ঘটবে… কিন্তু আমরা নিজেদের অজ্ঞাতসারে কত বিপদ নিজেই ডেকে আনছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সাংস্কৃতিক বিবর্তনের পথে অগ্রসর হয়ে মানুষ কলকারখানা বানাচ্ছে, বনজঙ্গল কেটে ফেলছে, বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করছে… এতই উন্নতির কথা ভাবতে লেগেছে যে, এতে পরিবেশের ভারসাম্য যে কতটা ক্ষতির সম্মুখীন তা সম্পর্কে কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই। আর এর মাশুল দিতে হচ্ছে। চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনা, ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনা, সাম্প্রতিক কালের আম্ফান ঘূর্ণিঝড়… কত শত শত মানুষের, সম্পত্তির ক্ষতি সাধন হয়েছে। যা গণনাতীত। আর এই ঘটনা বা দুর্যোগ যা মানুষ ও পরিবেশের ক্ষতি সাধন করে তাকে বিপর্যয় বলে… যা দুভাবে হয়। যখন প্রাকৃতিক ভাবে যেমন খরা, বন্যা, অগ্নুৎপাতের মত ঘটনা ঘটে তখন তাকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলা হয়ে থাকে। যখন মানবহস্ত দ্বারা পরিবেশের ক্ষতি সাধন হয়ে থাকে তাকে মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয় বলা হয়ে থাকে। যেমন — পারমাণবিক বিস্ফোরণ, ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনা। অনেক সময় আবার কিছু কিছু ভূমিকম্পকে মানব সৃষ্ট বিপর্যয় হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে, যেমন — মহারাষ্ট্রের লাতুর জেলায় যে ভূমিকম্প হয়েছিল তা সাধারণত মানুষের ভুলেরই মাশুল। আর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের একটি অন্যতম হল নদীর পাড়ের ক্ষয় (River Bank Erosion)। সাধারণত নদী তার প্রবাহপথে যখন নিম্নগতিতে এসে পৌঁছায়, তখন সে নিম্নক্ষয় অপেক্ষা পার্শ্বক্ষয় বেশি করে, একে নদীর পাড়ের ক্ষয় বলে। অন্যভাবে বলা হয় নদী যখন বার্ধক্য অবস্থায় বয়ে আনা নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতিকে তার দুই পাশে জমা করতে থাকে এবং যার ফলে নদীর দু’পাশ যখন ক্রমাগত ক্ষয় করতে থাকে, তাকে নদী পাড়ের ক্ষয় বলে। যেমন পশ্চিমবঙ্গের মালদা, মুর্শিদাবাদ, পূর্ব বর্ধমান জেলার নদী পাড়ের ক্ষয় এক দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার নদীর পাড় ক্ষয় ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ১৯৯৮ সাল থেকে মালদার কালিয়াচক-২ ব্লক এলাকায় গঙ্গার ভাঙন চরম আকার ধারণ করে। প্রায় এক দশকের মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় এই ব্লকের কেবি, ঝাউবোনা গ্রাম পঞ্চায়েতের বেশ কয়েকটি গ্রাম। বিপাকে পড়েন গ্রামগুলির লক্ষাধিক মানুষ। একদিকে যেমন নদী পাড় কাটতে থাকে, তেমনি অন্যদিকে গঙ্গার বুকে গজিয়ে উঠতে থাকে একাধিক চর। কয়েক বছরের মধ্যেই কেবি, ঝাউবোনা অঞ্চলের সম্পূর্ণ মাটি গঙ্গা নদীর মাঝে চররূপে জেগে ওঠে। এই চরগুলিতেই চাষাবাদ শুরু করেন গৃহহীন হয়ে যাওয়া কৃষকেরা। গঙ্গা ও ভাগীরথীর মিলনস্থলে পাগলা নদীর পশ্চিমে উর্দ্ধপ্রবাহে গড়ে উঠেছিল এক বিরাট চর।চরটির আয়তন ছিল প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার। সেই চরে বহু মানুষ চাষবাস করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকতেন। কিন্তু এবারে সেই চরের প্রায় ৮০% নদীতে তলিয়ে যায়। এই চরের ভাঙ্গনের ফলে বাঙ্গিটোলা ও পঞ্চানন্দপুরে বসবাসকারী প্রচুর কৃষক তাদের চাষবাসের জমি হারিয়েছেন। শুধু কৃষকেরা নয়, এই কেটে যাওয়া‌ চর দেখে প্রমাদ গুনেছেন বাঙ্গিটোলা, পঞ্চানন্দপুর এলাকার মানুষও। কথায় রয়েছে “নদীর ধারে বাস, ভাবনা বারোমাস”। গঙ্গার ভাঙ্গনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ডায়মন্ডহারবারও। কয়েক মাস আগে ডায়মন্ডহারবার গঙ্গার পাড় সংলগ্ন ১১৭ নম্বর জাতীয় সড়কে ধ্বস নামে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় কাকদ্বীপ, নামখানা, গঙ্গাসাগরের সাথে। নদী তাঁর আপন গতিতে বয়ে চলে… প্রতিটি নদী তাঁর গতি, ঢাল, দৈর্ঘ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এগিয়ে যায় এবং যখন প্রয়োজন হয় তখন নদী গতিপথ পরিবর্তন করে। নদীর গতি পরিবর্তন ও পাড় ক্ষয়ের কারণ স্বরূপ দেখা যায় নদীর পাড় ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে খুব দুর্বল এবং বেশিরভাগই বালির স্তর। যে কারণে নদীতে জলের পরিমাণ ও বেগ বৃদ্ধি পেলেই বালির স্তরে জল প্রবেশ করে ভাঙ্গন ধরে। তবে মানুষের হস্তক্ষেপেও নদীর পাড়ের ক্ষয়ের পরিমাণ বর্তমান যুগে খুবই বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন নদী তীরবর্তী অঞ্চলে কৃষিকাজ ও বৃক্ষহীন নদীর পাড়, নদীর ধারে বসতি নির্মাণ, কাঁচা সড়ক পথ নির্মাণ প্রভৃতিতে নদীর পাড় ক্ষয় হয়ে থাকে। প্রযুক্তিবিদরা নদীকে শাসন করতে চেয়েছেন প্রকৃতি-মানুষের উপর সম্ভাব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা না ভেবে। এমনই হঠকারিতার অন্যতম উদাহরণ হল ফারাক্কা ব্যারেজ প্রকল্প। ১৯৬১ সালে ২২৪০ মিটার দীর্ঘ ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ শুরু হয়, যার ফলে নদীর গতিপথের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। কিন্তু তার আগে অর্থাৎ ফারাক্কা বাঁধ গঠনের প্রাক্কালে নদী সোজা পথে প্রবাহিত হত। ফারাক্কা বাঁধ গঠনের পর নদী বেঁকে প্রবাহিত হয় ও গতিপথ পরিবর্তন করে। বাঁকের পরিমাণ দিন দিন বাড়তে থাকে, সাথে সাথে চরের পরিমাণও। ২০১২ সালে প্রকাশিত পি. কে. ঠাকুর, চলন্তিকা লাহা ও পি. আগরওয়াল রচিত গবেষণা প্রবন্ধ ‘River bank erosion hazard study of river Ganga, upstream of Farakka barrge using remote sensing and GIS’ -তে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে কতটা চরের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে তা জানা যায়। এখনও প্রতিবছর মোহানা থেকে প্রায় ২.১০ কোটি ঘনমিটার পলি অপসারণ করতে হয়। মূলত নদীর ডান দিকে ফারাক্কা ব্যারেজ অবস্থিত হওয়ায় বাঁদিকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।বর্ষার সময় নদী রাজমহল পাহাড়ে আঘাত করে ৪৫ ডিগ্রি কোণে বেঁকে প্রবাহিত হয়ে পঞ্চানন্দপুর ধাক্কা মারে ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই এলাকাটি। সুতরাং দিনের পর দিন নদীর বুকে হারিয়ে যাচ্ছে ভূমি। পশ্চিমবঙ্গ ভূমি রাজস্ব আইনের ১১/২ ধারায় বলা হয়েছিল, ভাঙ্গনে হারিয়ে যাওয়া জমি কুড়ি বছরের মধ্যে ওপারে চর জেগে উঠলে রায়তের অধিকার অক্ষুণ্ন থাকবে। ২০০০ সালে কোন এক অজ্ঞাত কারণে এই ধারাটি বাতিল করা হয়েছে এবং ১২ নম্বর ধারা অনুযায়ী চরের জমি খাস হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। মালদার ওপারের চরে গড়ে ওঠা বসতি ‘রাজস্ব গ্রাম’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। ২০১৮ সালে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার পার্কে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, “যদি এই নদীকে আমরা পরিচ্ছন্ন করে তুলতে পারি তাহলে দেশের ৮০% মানুষের বিরাট উপকার হবে”। তাই গঙ্গাকে পরিষ্কার করার জন্য ভারত সরকার “নমামি গঙ্গে” নামের একটি উদ্যোগ নিয়েছে, যা এক ধরনের অর্থনৈতিক কর্মসূচিও বটে। কিন্তু প্রতিবছর বর্ষায় আজও আগ্রাসী গঙ্গা ভেঙে ফেলেছে সব বোল্ডারের তৈরি প্রতিরোধ। এমন অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। যাইহোক, আমরা যদি একটু সচেতন হই তাহলে হয়তো আমাদের পক্ষেই তা ভালো হয়ে দাঁড়াবে। প্রকৃতির ভারসাম্যের বিরুদ্ধে গিয়ে যদি আমরা নদীকে তার স্বাভাবিক গতিপথে বইতে না দিয়ে বাধাপ্রাপ্ত করি, তাহলে তো বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। আমাদের আরও সচেতন মূলক প্রকল্প বাস্তবায়নের রূপ দিতে হবে। অবিলম্বে গঙ্গা থেকে বালি অনিয়মিতভাবে তোলা রোধ করতে হবে, কলকারখানা থেকে আবর্জনা, বর্জ্য পদার্থ ফেলা নিষেধ করতে হবে, গঙ্গার নাব্যতা বাড়াতে চূড়ান্ত ড্রেজিং করতে হবে। নদীর বাঁদিকে ক্ষয়ের চাপ কমিয়ে আনতে হবে, ভারী ও মাঝারি শিলা দিয়ে বাঁধ তৈরি করতে হবে, সঠিক সমীক্ষার মাধ্যমে গতিপথ সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করতে হবে, বালির বস্তা সাজিয়ে নদীর ক্ষয় রোধ করা যেতে পারে। এছাড়াও জিওসিন্থেটিক পদ্ধতিতে নদীর ভাঙ্গন রোধ করা যেতে পারে। এই সমস্ত ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে নদীর পাড়ের ক্ষয় প্রতিরোধ করা সম্ভব। তবে তার আগে মানুষের আরো সচেতন হওয়া উচিত। না হলে সেই দিন আসন্ন যে দিন, হা-হতাশ করা ছাড়া উপায় থাকবে না। যে গঙ্গা সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল সেই গঙ্গা সভ্যতা ধ্বংসের কারণ হবে। আর তার দায়ী কে হবে?… নিঃসন্দেহে আমরা।


লেখিকাঃ- দীপিকা বিশ্বাস (কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান)
[লেখিকা বর্তমানে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল স্নাতকোত্তর বিভাগের ছাত্রী]
তথ্যসূত্রঃ- উইকিপিডিয়া ; আনন্দবাজার পত্রিকা ;
সমকালীন ভূগোল – জ্যোতির্ময় সেন
প্রথম প্রকাশঃ- ভূগোলিকা ফেসবুক পেজ, চতুর্থ বর্ষপূর্তি-৩০/০৩/২০২১

©ভূগোলিকা-Bhugolika
©মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া

Content Protection by DMCA.com
এখান থেকে শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js //pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js
error: মিশন জিওগ্রাফি ইন্ডিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত